চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মায় ইলিশ শিকার চলছেই
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
চাঁপাইনবাবগঞ্জে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পদ্মা নদীতে ইলিশ নিধন চলছেই। ফলে পদ্মার উজানে ইলিশ সংরক্ষণের উদ্যোগ অনেকটায় ব্যর্থ হতে বসেছে। অভিযোগ উঠেছে, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করছে নদীতে। অভিযানের খবর আগে জেলেদের কাছে চলে যাওয়ায় মিলছে না সুফল।
ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে ১১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এ জন্য জেলেদের খাদ্য সহায়তাও দিচ্ছে সরকার। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন ২০০০ জন জেলে। কিন্তু এরপরও বন্ধ হয়নি ইলিশ ধরা।
সদর উপজেলার আলাতুলি, দেবীনগর, শাহজাহানপুর, নারায়ণপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা, উজিরপুর, মনাকষা ও দুর্লভপুরে ইউনিয়নে নিষেধাজ্ঞার পরও চলছে অবাধে ইলিশ নিধন। মৎস্য অধিদপ্তরের অভিযান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের খবর পৌঁছে যায় জেলেদের কাছে। তাই অভিযানের সময় বন্ধ রাখলেও পরে আবারও ইলিশ ধরছেন জেলেরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জেলায় পদ্মা নদীর দৈর্ঘ প্রায় ৪০ কিলোমিটার। সত্তর দশকের আগে রাজশাহীর কয়েকটি পয়েন্টের পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা নদীকেও ইলিশের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে যায়। মা ইলিশ ও জাটকা ইলিশ নিধনের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে ইলিশ সংরক্ষণে সরকার নানান উদ্যোগ নেয়। এতে মানুষ সচেতন হওয়ায় জাটকা নিধন কমে। যে কারণে ইলিশ পুরনো জায়গায় ফিরতে শুরু করে। ২০১৪ সালের পর আবার ইলিশ দেখা যায় পদ্মায়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা নদীতে প্রতি রাতেই ইলিশ মাছ ধরা হচ্ছে। ওই মাছ বিক্রির জন্য প্রত্যন্ত চর এলাকায় বসানো হয়েছে অস্থায়ী বাজার। সেখানে প্রকাশ্যে ইলিশ মাছ বিক্রি করা হচ্ছে। এখান থেকে মাছ কিনে ব্যবসায়ীরা জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ও ফেরি করে বিক্রি করছেন। এছাড়াও পদ্মার তীরবর্তী বাসিন্দারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেলে করে জাটকা ইলিশ বিক্রি করছেন ২৫০ টাকা কেজি দরে। ওজনের ভিত্তিতে দাম কম-বেশ হয়। দুটো ইলিশে এককেজি ওজন হয় এমন মাছের দাম প্রায় ৬০০-৭০০ টাকা।
ওই এলাকার জেলেরা জানিয়েছেন, ইলিশ ধরার পর মোবাইল ফোনে দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কখনো তারা লোক পাঠিয়ে মাছ নিয়ে যান, আবার কখনো জেলেরা কারো মাধ্যমে মাছগুলো পাঠিয়ে দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদর উপজেলার হড়মা এলাকার এক জেলে জানান, সরকার যে খাদ্য সহায়তা দেয়, তা খুবই কম। এই খাদ্য সহায়তা দিয়ে জেলেদের মাছ ধরা থেকে বিরত রাখা যাবে না। পেটে টান পড়লে কেউ নিষেধাজ্ঞা মানে না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে মৎস্য বিভাগ। কিন্তু অভিযানের সময় কিছুটা বিরত থাকলেও অভিযান শেষে আবারও মাছ ধরা শুরু করে জেলেরা। কখনও কখনও তারা গভীর রাতে মাছ ধরতে যায়। ওই সময় তো আর অভিযান চালানো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ‘বিশাল এই পদ্মা নদীতে অভিযান চালিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা সম্ভব নয়, যদি জেলেরা সচেতন না হয়। আমরা চেষ্টা করছি জেলেদের সচেতন করার। আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, যে মা মাছ না ধরলে ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। ওই মাছ জেলেরাই ধরে বিক্রি করতে পারবে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, জেলেদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এই চাল দিয়ে তাদের নিষেধাজ্ঞার সময় পার হয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও জেলেদের বলা আছে, কারো ঘরে খাবার না থাকলে জরুরি সেবা নম্বরে কল দিতে। তাহলে জেলা প্রশাসনের জরুরী খাদ্যসেবা থেকে খাবার পৌঁছে যাবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত নৌপুলিশের ওসি (গোদাগাড়ী অঞ্চল) তারেকুল ইসলাম বলেন, জনবল সংকটের কারণে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদীগুলো কড়া নজরদারি করতে পারছে না নৌপুলিশ। তবে কোথাও খবর পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে টিম পাঠিয়ে ইলিশ ধরা বন্ধ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ইলিশ ধরা বন্ধে জেলেদেরও সচেতন হতে হবে। মা ইলিশ ধরলে বা জাটকা ইলিশ ধরলে সবচেয়ে ক্ষতি জেলেদেরই হয়। মা ইলিশ বা জাটকা নিধন কমে আসলে এবং ইলিশের বিচরণক্ষেত্র বিস্তৃত হতে শুরু করে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পরীসংখ্যান অনুযায়ী, ১২ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞার পর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৭টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ ২৬টি অভিযান চালানো হয়েছে। এসব অভিযানে ১১০ কেজি ইলিশ জব্দ করা হয়। জাল ধ্বংস করা হয় ১ লাখ ৮ হাজার ৩৮ মিটার। যার আনুমানিক মূল্য ২১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এ সময়ের মধ্যে চার জেলের বিরুদ্ধে মামলা, দুইজনকে জেল ও ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
শিয়াম/বকুল