ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ জুন ২০২৫ ||  আষাঢ় ১০ ১৪৩২

দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর সুনাম

রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৮, ২৩ মে ২০২৫  
দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর সুনাম

বাগান থেকে পেড়ে আনা লিচু

‘চায়ের দেশ’ ‘আমের শহর’—এসব অভিধা দেশে প্রচলিত আছে। এর পাশাপাশি ‘লিচুর গ্রাম’ হিসেবে ক্রমেই পরিচিত হয়ে উঠছে মঙ্গলবাড়িয়া। এই গ্রামের লিচুর সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। 

কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে পাকুন্দিয়া উপজেলার একটি গ্রাম মঙ্গলবাড়িয়া। এ গ্রামের নামেই লিচুর নাম- ‘মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু’। লিচু চাষ করেই দেশখ‌্যাত এই গ্রাম। 

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের অধিকাংশ মানুষ লিচু চাষ করে এখন স্বাবলম্বী। লিচু চাষে ভাগ্য ফিরেছে তাদের। প্রতি মৌসুমেই মঙ্গলবাড়িয়ায় লিচু বিক্রি হয় কয়েক কোটি টাকার। এ মৌসুমে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রির আশা করছেন মঙ্গলবাড়িয়ার চাষি ও কৃষি বিভাগ। 

ঠিক কত বছর আগে এবং কীভাবে এ গ্রামে লিচু চাষ শুরু হয়েছিল, তার সঠিক কোনো তথ‌্য কারো জানা নেই। ধারণা করা হয়, প্রায় ২০০ বছর আগে এ গ্রামেরই একজন চীন থেকে লিচুর চারা এনে তার বাড়ির আঙিনায় রোপণ করেন। তারপর একে একে পুরো গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ছড়িয়ে যায় এ লিচু। প্রথমে নিজেদের খাওয়ার জন্য গাছ রাখলেও কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবেই হচ্ছে লিচু চাষ। তাই, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের নামেই লিচুর নামকরণ করা হয়েছে। এখন এই লিচুর জন‌্যই বিখ‌্যাত হয়ে উঠেছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রাম। এ গ্রামের লিচু চাষ দেখে উদ্বুব্ধ হয়ে এ বছর পাশের আরো তিনটি গ্রাম—কুমারপুর, নারান্দী এবং হোসেন্দীতেও কৃষি বিভাগের পরামর্শে লিচু চাষ শুরু হয়েছে।

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রবেশকালে পাকা সড়কের দুই পাশেই দেখা যায় সারি সারি লিচু গাছ। হাজার হাজার লিচু থোকায় থোকায় ঝুলছে গাছগুলোতে। লাল টকটকে পাকা লিচু দেখলে যে কারো খেতে লোভ জাগবে। টসটসে রসালো, সুমিষ্ট স্বাদ, সুন্দর গন্ধ ও গাঢ় লাল রঙের কারণে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর খ্যাতি ছাড়িয়ে পড়েছে মধ‌্যপ্রাচ‌্যেও। বছরের পর বছর ধরে মঙ্গলবাড়িয়ার সুস্বাদু লিচু ফলপ্রেমীদের তৃপ্তি মিটিয়ে আসছে।

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের মো. হাবিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে লিচু চাষ করছেন। এ বছর তার বাগানে ৩০ থেকে ৩৫টি গাছে থোকায় থোকায় লিচু ধরেছে। তিনি জানান, আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে লিচু চাষ করছি। আমাদের বাড়িতে ১৫০ বছরের পুরনো গাছও আছে। এমন তিনটি গাছ থেকেই প্রায় ২ লাখ টাকার লিচু বিক্রি হয়। এ বছর নতুন আরো একটি বাগানে লিচুর ব্যাপক ফলন হয়েছে। আশা করছি, সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার লিচু বিক্রি হবে। সেখান থেকে ভালো লাভও হবে।
 
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রথম বাণিজ‌্যিকভাবে লিচু চাষের উদ‌্যোগ নেন তৌহিদুল ইসলাম। তার হাত ধরেই গ্রামের প্রতিটি আঙিনায় লিচুর চাষ শুরু হয়। 

তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রথম প্রথম লিচু চাষ করে ভালো ফলন পেলেও যাতায়াত ব‌্যবস্থা ভাল না থাকায় ভাল দাম ও প্রচার পেতে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে এখানকার চাষিদের। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের লিচু সারা দেশে ব‌্যাপক সাড়া ফেলে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এখানকার চাষিদের। লিচু চাষে ভাগ্য বদলেছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের হাজারও মানুষের। 

প্রতি মৌসুমে লিচু বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের চাষিরা। বর্তমানে এ গ্রামের বেশিরভাগ কৃষকের উপার্জনের মূল উৎস লিচু। অনেক কৃষকেরই আছে শতাধিক লিচু গাছ। লিচু চাষ এ এলাকার কৃষকদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছে। লিচু বিক্রির টাকাতেই সারা বছরের ব্যয় নির্বাহ করেন তারা। লিচু বাগানগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে শত শত শ্রমিকের।

কথা হয় কিছু নবীন উদ্যোক্তার সঙ্গে। তারা জানান, বাপ-দাদাদের দেখানো পথে হাঁটছে এ অঞ্চলের নতুন প্রজন্ম। লেখাপড়ার পাশাপাশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন লিচু চাষে। কম পরিশ্রমে লাভ বেশি। তাই, দিন দিন লিচু চাষ বাড়ছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে। লিচু চাষে খরচ খুবই কম। সে তুলনায় লাভ অনেক বেশি।

তারা মনে করেন, শুধু লিচুর মাধ‌্যমে দেশের বাইরেও মঙ্গলবাড়িয়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। একসময় তাদের হাত ধরেই আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে এখানকার লিচু চাষ। পাল্টাবে অর্থনৈতিক চিত্র। মঙ্গলবাড়িয়া লিচুর জন‌্য হয়ে উঠবে একটি মডেল গ্রাম। 

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ২০ দিন ধরে চলছে লিচু আহরণের কাজ। আরো কিছুদিন তা চলবে। বেশিরভাগ গাছেই লিচু পেকে গাঢ় লাল রঙের হয়েছে। বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ লিচু। কিছু গাছে লিচুর রং গাঢ় সবুজ থেকে লাল হতে শুরু করেছে। শেষ সময়ে চাষিরাও নিয়মিত লিচুগাছ পরিচর্যায় ব‌্যস্ত সময় পার করছেন। এ বছর ফলন ভাল হলেও তীব্র খরায় প্রথমে আকারে কিছুটা ছোট ছিল। শেষে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। পাইকার বা খুচরা ক্রেতা আসলেই গাছ বুঝে দর-দাম কষে বিক্রি হচ্ছে লিচু। রাস্তার দুই ধারে লিচু গাছগুলোর সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল রঙের রসালো পাকা লিচুগুলো দেখলে মনে হয়, প্রকৃতি যেন অপরূপ সৌন্দর্য‌্য দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামকে।

অনেকে ঘুরতে আসেন লিচুর গ্রাম খ্যাত মঙ্গলবাড়িয়ায়। তারা সারি সারি লিচুর গাছ দেখে বিমোহিত হন। কেউ ছবি তোলেন বা ভিডিও করেন। তাদের বেশিরভাগই পছন্দমতো লিচু কিনে নিয়ে যান। মঙ্গলবাড়িয়া গ্রাম এখন দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর স্বাদ নিতে ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা প্রতিদিনই সকাল-বিকেল ভিড় করছেন লিচু বাগানে। এ সময়ে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে যেন ঈদের আমেজ থাকে। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ভিড় করেন আত্মীয়-স্বজনরাও।

ইউটিউবে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর ভিডিও দেখেছেন রেজিয়া পারভীন। তারপর নরসিংদীর বেলাবো থেকে ঘুরতে এসে প্রথমে গাছপাকা লিচু খেয়েছেন, তার পর বাড়ির সবার জন্য কিনেছেন ১ হাজার লিচু। 

রেজিয়া পারভীন বলেন, অনেক ভিডিও দেখছি এ গ্রামের। বলা যায়, একপ্রকার ভাইরাল লিচুর গ্রাম। এসেও তা-ই দেখলাম। বিকেলে প্রচুর মানুষজন আসছে, ছবি তুলছে, লিচু কিনছে, খাচ্ছে ও নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে দাম একটু বেশি মনে হয়েছে। খাওয়ার পরে মনে হয়েছে, স্বাদ অনুযায়ী দাম ঠিকই আছে। লিচুর আকৃতি অনুযায়ী ২০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকার লিচু এখানে পাওয়া যাচ্ছে।

বিক্রেতা মানিক মিয়া জানিয়েছেন, সারা দেশেই মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর খ‌্যাতি আছে। তাই, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন শত শত পাইকার ও খুচরা ক্রেতা। আকারভেদে প্রতি ১০০ লিচু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। প্রবাসী বাঙালিরাও এ লিচুর স্বাদ নিচ্ছেন বহু বছর ধরে। একবার যারা এ লিচুর স্বাদ পেয়েছেন, তারা প্রতি মৌসুমেই এখানে চলে আসেন।

পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-ই-আলম জানিয়েছেন, মঙ্গলবাড়িয়া ও আশপাশের তিনটি গ্রামে ৮ হাজারের বেশি ছোট-বড় লিচু গাছ আছে। স্থানীয়ভাবে এ জাতের লিচু খুবই ভাল। গাছে মুকুল ধরা থেকে শুরু করে ফল আহরণ এবং বিক্রির সময়টুকু পর্যন্ত যাবতীয় তদারকি করে থাকেন স্থানীয় কৃষি অফিসাররা। যেসব কৃষক অন্যান্য ফসলে লাভবান হতে পারেননি, তারা এখন লিচু চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি তরুণ উদ‌্যোক্তাও তৈরি হয়েছে, যারা পড়াশোনার পাশাপাশি লিচু চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

ঢাকা/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়