ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৫ জুলাই ২০২৫ ||  আষাঢ় ৩১ ১৪৩২

পোশাক খাতে নেতৃত্ব দিতে অনীহা নারী শ্রমিকদের 

রেজাউল করিম, গাজীপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ৫ জুলাই ২০২৫   আপডেট: ১৯:৪০, ৫ জুলাই ২০২৫
পোশাক খাতে নেতৃত্ব দিতে অনীহা নারী শ্রমিকদের 

অনেক নারীই নিরাপদ থাকার মানসিকতা থেকে নিচের পদে থেকে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন

বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের প্রাণ নারী শ্রমিকরা৷ তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরী হয় বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাক। স্বল্প মূল্য ও ভালো মানের কারণে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পোশাকের বিপুল চাহিদা। বাংলাদেশে পোশাক খাতে বেশিরভাগ শ্রমিকই নারী। তবে, নেতৃত্বে তাদের অংশগ্রহণ খুবই কম৷ কারখানায় কর্মী ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা এবং শ্রমিক সংগঠগুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনীহা নারীদের। 

শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শিল্পঅধ্যুষিত গাজীপুর জেলায় ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানা আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি পোশাক কারখানা। এসব কারখানায় কাজ করেন লাখ লাখ নারী।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ পোশাক কারখানায় একটি লাইনে দুজন করে সুপারভাইজার ও একজন লাইনম্যান থাকেন। তারা ওই লাইনে কর্মরত শ্রমিক ও অপারেটরদের নিয়ন্ত্রণ করেন এবং চাহিদা অনুযায়ী কাজ আদায় করেন৷ এসব সুপারভাইজার ও লাইনম্যান সবাই শ্রমিক থেকে এই পদে পদোন্নতি পান৷ তবে, অধিকাংশ কারখানায় পুরুষদের সমান দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কোনো নারী শ্রমিক এসব দায়িত্ব পালন করছেন না৷ নারীরা ১০-১২ বছর ধরে অপারেটর পদেই রয়ে যান৷ অথচ, অনেক পুরুষ কর্মী কম সময়েই নেতৃত্বস্থানীয় পদে কাজ করছেন। উৎপাদন লাইনে নারীর সংখ্যা বেশি থাকলেও, নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পরামর্শ বা সহায়তা তাদের খুব কমই দেওয়া হয়। ফলে, অনেকেই নিজেকে অযোগ্য মনে করেন, যদিও তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন নেতৃত্বের দক্ষতা বিদ্যমান। 

আরো পড়ুন:

উচ্চ পদ মানেই বড় দায়িত্ব, তাতে ভুল হলে চাকরি হারানোর আশঙ্কাও বেশি। অনেক নারীই নিরাপদ থাকার মানসিকতা থেকে নিচের পদে থেকে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু, সেটি তাদের পারিবারিক পিছুটান ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার বহিঃপ্রকাশ।

নারীরা নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহ ও পিছিয়ে কেন, এ বিষয়ে প্রতিবেদন লেখার জন্য গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় ছয় বছরের অধিক সময় ধরে কাজ করেন, এমন অর্ধশতাধিক নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলা হয়৷ কর্মক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বে অনাগ্রহ ও অসুবিধার বিষয়ে নানা বিষয় তুলে ধরেন তারা৷ 

নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ জানা গেছে৷ এসবের মধ্যে আছে—শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকা, সন্তানকে বেশি সময় দেওয়া, কাজ শেষে সংসারের দায়িত্ব পালন, ঝুঁকিমুক্ত থাকা, নারী অধিকার কর্মীর সংকট এবং মাতৃত্বকালীন সময় প্রভৃতি। 

‎লালমনিরহাট জেলা থেকে ১২ বছর আগে গাজীপুরে আসেন মালেকা বেগম৷ তখন থেকেই লিজ ফ্যাশন লিমিটেডের কারখানায় কাজ করেন তিনি৷ কাজে তার দক্ষতা অসাধারণ। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাকে পদোন্নতি দিতে চেয়েছে একাধিকবার, কিন্তু তিনি রাজি হননি৷ 

মালেকা বেগম বলেন, “আমি সিনিয়র অপারেটর হিসেবেই ভালো আছি৷ সুপারভাইজার ও লাইনম্যানের দায়িত্ব নিতে চাই না৷ এসব দায়িত্ব বোঝা মনে হয়৷ জবাবদিহি ছাড়াও অতিরিক্ত সময় দিতে হয়৷ তার থেকে ভালো হলো—কাজ শেষে পরিবারকে বেশি সময় দেওয়া৷”

টাঙ্গাইল জেলার সালমা খাতুন প্রায় ১৫ বছর ধরে পোশাক কারখানায় কাজ করেন৷ তিনি বলেন, “গার্মেন্টসে কাজ করে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি৷ সব কাজই পারি, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার সাহস পাই না৷ পড়াশোনা নেই তেমন। কাজ জানা থাকলেও অনেক কিছু পড়তে পারি না৷ তাছাড়া, মেশিনকে কথা শোনানো সহজ, কিন্তু মানুষকে চালানো কঠিন। এজন্য দায়িত্ব নেওয়া হয় না।”

এক পোশাক কারখানার প্রশাসনিক ও মার্কেটিং কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ নাহিদ বলেছেন, “পোশাক খাতের প্রাণ নারী শ্রমিকরা৷ তারাই এই শিল্পকে বিকশিত করেছেন। তবে, বিপুল অংশগ্রহণ থাকলেও তারা নেতৃত্ব দিতে চান না৷ তাদেরকে অনুরোধ করা হলেও রাজি হন না৷ তারা বাড়তি চাপ নিতে অনাগ্রহী। তবে বর্তমানে অনেক কারখানায় শিক্ষিত নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন।”

সচেতন মহল বলছেন, নারী নেতৃত্ব বাড়াতে এবং বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ। নারী নেতৃত্ব তৈরির জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ, নারী কর্মীবান্ধব নীতিমালা এবং পরিবার ও সমাজের মানসিক কাঠামোতে পরিবর্তন জরুরি। নারীদের পদোন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো সমাজের চোখে তার ভূমিকাকে শুধু ‘পরিচর্যাকারী’ হিসেবে দেখা। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীদের নেতৃত্বের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।

শ্রমিক নেতা ও ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আন্দোলনের সংগঠক আরমান হোসাইন বলেছেন, “‎আমাদের দেশের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি হলো পোশাক শিল্প। আবার পোশাক খাতের প্রধান চালিকাশক্তি নারীরা। আমাদের দেশের সমাজ ও কাঠামোই এমনভাবে তৈরি, যা নারীদের পিছিয়ে রাখে। নারী-পুরুষের মধ্যে সামাজিক যে বৈষম্য গড়ে উঠেছে, তা পোশাক শিল্পেও উপস্থিত। নারী শ্রমিকরা প্রায়শই যৌন হয়রানির শিকার হন, কটূক্তি শুনতে হয়, অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীরা নারীর নেতৃত্ব মানতে চান না। এছাড়া, নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব আছে। নারীদের কারখানায় শ্রম দিয়ে আবার বাসার কাজ সামলানো ও সন্তান লালনপালন করতে হয়। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে। এসব কারণেই মূলত নারীরা নেতৃত্বস্থানীয় পদে যাওয়ার কথা ভাবতেই ভয় পান।” 

এ বিষয়ে লেখক ও সাংবাদিক ফারদিন ফেরদৌস বলেছেন, “বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বিপুল ও অপরিহার্য। শ্রমঘন এই শিল্পের প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছেন লাখো নারী শ্রমিক। কিন্তু, একটি দুঃখজনক বৈষম্য আজও চোখে পড়ে—যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীরা পোশাক শিল্পের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব পান না। এর পেছনে আছে বহুস্তরীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো। কর্মক্ষেত্রের বাইরেও নারীর কাঁধেই বর্তায় পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ, সন্তানের দেখভাল, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সেবা, এমনকি আত্মীয়-স্বজনের দায়িত্বও। ফলে, পেশাদার জগতে উচ্চ পদে গিয়ে অতিরিক্ত সময় ও মানসিক চাপ গ্রহণ অনেক নারীর পক্ষেই বাস্তবসম্মত হয় না। তাদের প্রশিক্ষণ ও মনোবল বৃদ্ধি করা গেলে দারুণ উৎসাহে নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ আছে অজস্র নারীর৷ 

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়