‘হাসপাতালে দেখি ছেলের নিথর দেহ, রক্তে ভেজা’
আরিফুল ইসলাম সাব্বির, সাভার || রাইজিংবিডি.কম
রাস্তায় পড়ে আছে শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের নিথর দেহ। ইনসেটে তার বাবা মহিউদ্দিন।
ঠিক এক বছর আগে, সাভারের রাস্তায় পড়ে ছিল এক তরুণের রক্তাক্ত দেহ। শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। মেধাবী, পরিশ্রমী, বিনয়ী এক তরুণ। তার পরিবার আজও সেই দৃশ্য ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি তার বাবা মো. মহিউদ্দিনও।
আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “শহীদের রক্তমাখা কাপড়ই কাফন হয়। তাই আমার ছেলেকে যে কাপড় পরে গুলি খেয়েছে, সে কাপড়েই দাফন করেছি।”
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল রাজপথ। নানা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় থানা রোড এলাকায়। দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাঁজোয়া যান নিয়ে এগিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এমআইএসটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন পুলিশের গুলিবর্ষণ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সাঁজোয়া যানটিতে উঠে পড়েন।
ঠিক সেই সময়, পুলিশের ছররা গুলি লাগে তার বুকে। তিনি লুটিয়ে পড়েন। এরপর যেভাবে তার শরীরকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়, তা সামাজিক মাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
শহীদ ইয়ামিন ছিলেন সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন মহল্লার বাসিন্দা। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। থাকতেন এমআইএসটির ওসমানী হলে। পরিবারের বড় সন্তান। বাবা মহিউদ্দিন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা।
সেদিন দুপুরে জোহরের নামাজ শেষে বাসা থেকে বেরিয়ে যান ইয়ামিন। আর ফেরেননি। বিকেল নাগাদ খবর আসে-তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে। বাবার ভাষায়, “হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলের নিথর দেহ। বুকের বাম পাশে শটগানের গুলি। শরীর রক্তে ভিজে গেছে।”
ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়েও বাবার আবেগ জড়িয়ে, “তালবাগ কবরস্থানে দাফন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। পরে ছেলের এক বন্ধুর সহযোগিতায় ব্যাংক টাউনের কবরস্থানে দাফন করি। যেই পোশাকে সে শহীদ হয়েছে, সেটাই তার কাফন।”
পরবর্তীতে আদালত থেকে মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ আসে। কিন্তু শহীদের মর্যাদা রক্ষায় পরিবার তাতে রাজি হয়নি। “আমার ছেলের গায়ে যেন আর কেউ হাত না দেয়। সে শহীদ হয়েছে, আমি চাই আল্লাহ যেন তাকে আখিরাতে শহীদের মর্যাদা দেন,” বলেন মহিউদ্দিন।
ইয়ামিনের হত্যার ঘটনা নিয়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং ছাত্র সমাজ সোচ্চার হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাও গৃহীত হয়েছে। তবে এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
মহিউদ্দিন বলেন, “আমরা অপেক্ষা করছি। কিন্তু কতদিন? আমার ছেলে যে হত্যা হয়েছে, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। ভিডিও আছে, সাক্ষী আছে। বিচার কেন হচ্ছে না?”
এই প্রশ্ন শুধু এক বাবার নয়, এটি আজকের বাংলাদেশের তরুণদের পক্ষ থেকেও। কারণ ইয়ামিন শুধু একজন ছাত্র নয়, হয়ে উঠেছেন একটি সময়ের প্রতীক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক সাহসী কণ্ঠস্বর।
এক বছর পরও সাভারে আয়োজিত স্মরণসভায় বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, শিক্ষার্থীরা তার ছবি হাতে দাঁড়ায়। মোমবাতি জ্বালিয়ে বলে, “তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেই না, ইয়ামিন ভাই।”
ঢাকা/এস