কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
৫০ শয্যার হাসপাতালে দৈনিক সাত শতাধিক রোগীর চাপ
রফিক সরকার, কালীগঞ্জ (গাজীপুর) || রাইজিংবিডি.কম
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছে ৫০টি শয্যা। তবে, এখানে প্রতিদিন সাত শতাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। রবিবার এ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। শুধু কালীগঞ্জ নয়; গাজীপুরের কাপাসিয়া, নরসিংদীর পলাশ এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকেও অসংখ্য রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন এখানে। এ অঞ্চলের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের কাছে হাসপাতালটি একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে।
শয্যা সংকট থাকা সত্ত্বেও আবাসিক বিভাগে প্রায় ৯০ জন রোগী রাখতে হয়েছে। কেবিন ও ওয়ার্ড পূর্ণ হয়ে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করিডোর বা বাইরে ঢালাও বিছানা করে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। কখনো কখনো একদিনে ৫০ জন নতুন রোগী ভর্তি হওয়ায় সবাইকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। চিকিৎসকরা আন্তরিক থাকলেও রোগীর আধিক্য থাকায় কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছেন ১৮ জন। এর মধ্যে চারজন ডেপুটেশনে আছেন—শিশু রোগ বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মুর্শিদা আক্তার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে (এনআইসিভিডি), মেডিকেল অফিসার ডা. খালেদ মাহমুদ কাশিমপুর কারাগারে, ডা. রিয়াজুল রহমান ভূঁইয়া কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এবং ডা. কে এম ইসতিয়াক রোহান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া, ডা. বুশরা তাবাসসুম নামের একজন মেডিকেল অফিসার ২০২৪ সালের ৩ মার্চ থেকে অনুপস্থিত। একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও তিনি কাজে যোগ দেননি।
গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিশেষজ্ঞ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ, দুজন সহকারী সার্জন এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক নেই।
তৃতীয় শ্রেণির ৯২টি পদের মধ্যে শূন্য ২৪টি। চতুর্থ শ্রেণির ২৫ কর্মচারীর মধ্যে আছেন মাত্র ৬ জন। শুধু দ্বিতীয় শ্রেণির ৩৫ পদ পূর্ণ রয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারী, আয়া, বাবুর্চি, মালি, এমএলএসসি, ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার, নিরাপত্তা প্রহরী, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেলথ ইন্সপেক্টর, স্টাফ নার্স, কার্ডিওগ্রাফার, ক্যাশিয়ার, হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট, হেলথ ইন্সপেক্টর, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম কম্পিউটার অপারেটর, স্টোর কিপার, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ও টিকেট ক্লার্ক—এসব পদে জনবল সংকট রয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. আবদুল করিম বলেছেন, “এখানে ভিড় অনেক বেশি। ডাক্তাররা চেষ্টা করেন সেবা দিতে, কিন্তু রোগীর চাপ এত বেশি যে ঠিকমতো সময় পাওয়া যায় না। তবু আমাদের মতো গরিব মানুষের ভরসা এই হাসপাতাল।”
কালীগঞ্জ উপজেলার গৃহবধূ রোকসানা আক্তার বলেন, “অনেক পরীক্ষা বাইরে থেকে করতে হয়। তারপরও এখানে ডাক্তার দেখাতে আসি। আমরা গরিব মানুষ, প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে ডাক্তারকে অনেক টাকা ভিজিট দিতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো আছেই। অনেক কম টাকায় ডাক্তার দেখাতে পারি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি, এজন্যই আসি।”
গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে আসা বৃদ্ধা হাজেরা বেগম বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার টাকা নেই। এখানে ভিড়ের মধ্যেও ফ্রি চিকিৎসা পাই, তাই কষ্ট হলেও আসতে হয়।”
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. রেজাউর হক বলেছেন, “প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। জনবল সংকট থাকা সত্ত্বেও কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। নির্ধারিত ৫০ শয্যার বাইরে আমরা ফ্লোরে বিছানা দিয়ে ভর্তি রাখি। পরে শয্যা খালি হলে রোগীদের স্থানান্তর করি।”
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজওয়ানা রশিদ বলেন, “নিয়োগ সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে দেওয়া হয়। নিয়োগ সম্পন্ন হলে শূন্য পদগুলো পূরণ হবে।”
গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মামুনুর রহমান বলেছেন, “জনবল সংকট এখন সারা দেশেই সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ থাকায় হাসপাতালগুলোতে জনবল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে ধাপে ধাপে এ সংকট কেটে যাবে।”
ঢাকা/রফিক