ডুমুরিয়ার জলাবদ্ধ ৪০ গ্রামে দুঃসহ জীবন
নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম
ডুমুরিয়ার ৪০ গ্রামে রাস্তা-ঘাট, বসতবাড়ি, মাছের ঘের, সবজিক্ষেত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবই পানির নিচে
ঘরে-বাইরে থই থই করছে পানি। কোথাও যেতে হলে একমাত্র ভরসা নৌকা। শুকনো জায়গার দেখা মিলছে না। দুর্বিসহ জীবন কাটছে পানিবন্দি মানুষদের। তাদের না আছে রান্নার জায়গা, না আছে ঘুমানোর জায়গা। সবই পানির নিচে। এমনকি নৌকায় করে বিলের মধ্যে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হচ্ছে তাদের। নিজেদের যেন মনে হচ্ছে জলজ প্রাণী। এ দুর্দশা নিরসনের ব্যবস্থা করার যেন কেউ নেই।
এটি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার জলাবদ্ধতার এলাকার চিত্র। এভাবেই পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন এখানকার বাসিন্দারা।
টানা প্রায় দুই মাস পানিবন্দি অবস্থায় আছেন ডুমুরিয়ার মানুষ। শৈলমারী রেগুলেটরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পাম্প দিয়ে নিষ্কাশন করলেও পানি কমেনি। বরং, ক্রমান্বয়ে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাস্তা-ঘাট, বসতবাড়ি, মাছের ঘের, সবজিক্ষেত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবই পানির নিচে। জলাবদ্ধতার কারণে কাজ করতে না পারায় অনেক পরিবার খাদ্য সংকটে পড়েছে। সরকারিভাবে জিআর চাল বিতরণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।
ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর, রঘুনাথপুর, ধামালিয়া, মাগুরাঘোনা, খর্ণিয়া, আটলিয়া, গুটুদিয়া ও ডুমুরিয়া ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছেন। জলমগ্ন অবস্থায় অসহায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। এ বছর ১০ জুলাই ভারী বৃষ্টির পর থেকে জলাবদ্ধতা শুরু হয়।
পানিবন্দি গ্রামগুলো হলো— মুজারঘুটা, বারানসি, সাড়াভিটা, বটবেড়া, কৃষ্ণনগর, দেড়লি, বশিরাবাদ, আন্দুলিয়া, কোমরাইল, চেচুড়ি, কাটেঙ্গা, টোলনা, বরুনা, গজেন্দ্রপুর, রুপরামপুর, রামকৃষ্ণপুর, শান্তিনগর, ঘোনা, বিলপাটিয়ালা, মাধবকাটি, মান্দ্রা, ময়নাপুর, বিলসিংগা, রানাই, পাঁচপোতা, ঘোষড়া, বাদুড়িয়া, আলাদিপুর, আটলিয়া, বয়ারশিং, আধারমানিক, খড়িয়া, কোমলপুর, গুটুদিয়া, পাটকেলপোতা, মির্জাপুর, হাজিডাঙ্গা, গোলনা, খলসী, সাজিয়াড়া ও আরাজি ডুমুরিয়া।
পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় তিন বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে এসব অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ বছর আগাম বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতাও আগে দেখা দিয়েছে।
পানিবন্দি বারানসি গ্রামের চন্দ্রকান্ত মণ্ডল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, পানিবন্দি মানুষের দুঃখের সীমা নেই। প্রায় দুই মাস পানিবন্দি অবস্থায় চরম দুর্বিসহ জীবন কাটছে। কিন্তু, কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। রাস্তায় হাটুপানি, উঠোনে কোমর পানি; রান্নার জায়গা নেই, জ্বালানি কাঠও নেই। এক সকালের রান্না পরের দিন সকাল পর্যন্ত খেতে হচ্ছে। নৌকা-ডিঙিতে চড়ে বিলের মধ্যে মলমূত্র ত্যাগ করতে হচ্ছে। মেঘ দেখলেই আসে ভয়, না জানি এবার কী হয়।
সাজিয়াড়া আবাসনের হালিমা বেগম জানান, তাদের ঘরের মধ্যে কোমরপানি। মাচা করে থাকতে হচ্ছে তাদের। আবাসনের ৫৮টি ঘরের সবই পানির নিচে। দুই দিন পরপর রান্না হয়। বেশিরভাগ সময় শুকনো খাবার খেতে হয়। উপজেলা প্রশাসন কয়েকদিন আগে চাল-ডাল-তেল দিয়েছে। তাদের খাবারের চেয়ে থাকার জায়গা আগে দরকার। পচা পানির দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত সাপ-পোকার উপদ্রব বেড়ে গেছে আবাসনে।
রঘুনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোজিত বালা ও রংপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সমরেশ মণ্ডল জানিয়েছেন, শৈলমারী ১০ ভেন্ট রেগুলেটর দিয়ে বিল ডাকাতিয়াসহ ডুমুরিয়ার উত্তরাঞ্চলের পানি নিষ্কাশন হয়ে থাকে। ভদ্রা নদী পলিতে ভরাট হওয়ার কারণে শৈলমারী গেট দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি সাব-মার্সিবল পাম্প দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হলেও আশানুরূপ পানি বের হচ্ছে না। এ বছর বৃষ্টির পরিমান অনেক। তাই, ক্রমন্বয় বাড়ছে পানি। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এস এম আবু আব্দুল্লাহ বায়েজিদ জানিয়েছেন, প্লাবিত অঞ্চলের মানুষের মাঝে ৫০ মেট্রিক টন জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু, পানিবন্দি মানুষরা ত্রাণ চাচ্ছেন না। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের দাবি জানিয়েছেন তারা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে আমিন জানিয়েছেন, ভারী বর্ষণে প্রায় ১০০ হেক্টর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। এতে করলা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, সিম, চিচিঙা, ঝিঙ্গা, শশাসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৯ কোটি টাকার সবজি নষ্ট হয়েছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সোহেল মো. জিল্লুর রহমান রিগান জানিয়েছেন, বন্যায় প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল-আমিন জানিয়েছেন, ডুমুরিয়ায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি ও উপজেলা প্রশাসন একযোগে চেষ্টা চালাচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য। পানি নিষ্কাশনে খালগুলো উন্মুক্ত করা হচ্ছে। সব গেট দিয়ে পানি বের করা চেষ্টা চলছে। কালিঘাট স্লুইস গেটের কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। ময়ুর নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। খুব শিগগির পানিবন্দি মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেছেন, বিল ডাকাতিয়াসহ ডুমুরিয়া অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের জন্য শৈলমারী গেটের মুখ থেকে শুরু করে আপার সালতা পর্যন্ত জরুরিভাবে পলি অপসারণের কাজ শুরু করা হয়েছে। দুটি ভাসমান ভেকু ও দুটি লংবুম ভেকু দিয়ে খননের কাজ চলছে। আশা করি, দ্রুত পানি নিষ্কাশন হবে। গত ২২ আগস্ট পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
তিনি বলেন, প্রায় ৫০ কোটি টাকার নদী ড্রেজিং, ২৬টি খাল পুনঃখননসহ পাঁচটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প স্থাপন প্রকল্প অনুমোদনের পথে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব হবে।
ঢাকা/নূরুজ্জামান/রফিক