স্পর্শ আর অনুভবে হস্তশিল্পে অনন্য মৃত্যুঞ্জয়
মনোয়ার চৌধুরী, সুনামগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
হস্তশিল্পের কাজ করছেন দৃষ্টিহীন মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস
চোখে আলো নেই, হৃদয়ে তার জ্বলে এক অন্যরকম দীপ্তি। অন্ধত্ব তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, বরং ছুঁয়েই শিখেছেন, তৈরি করেছেন নিজের কাজের এক দারুণ জগৎ। দৃষ্টির অভাবকে শক্তিতে রূপ দিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজের একটা কর্মজগৎ। যেখানে হস্তশিল্পই তার হাতিয়ার, আর আত্মনির্ভরতা তার প্রতিজ্ঞা।
প্রতিকূলতাকে জয় করে, একা হাতে সংসারের হাল ধরেছেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের কর্ণগাঁও গ্রামের দৃষ্টিহীন মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস (৩২)।
এই হতদরিদ্র মৃত্যুঞ্জয় দুই চোখে দেখতে পান না, চাইলেই হতাশায় ডুবে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন সংগ্রামের পথ। বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্র তৈরি করাই তার পেশা।
স্পর্শ আর অনুভবে প্রতিদিনই তৈরি করেছেন কুলা, চাটাই, চাঙারি, টুকরি, উড়া, ডালা, চালুনি কিংবা মাছ ধরার খলই। এমনকি হাঁস-মুরগির খাঁচাও তার হাতের কারুকার্যে হয়ে উঠে দারুণ শৈল্পিক। এটিই তার রুটিরুজির মাধ্যম। বর্তমানে তার পরিবারের কেউ আর অভুক্ত থাকে না; বরং তার শ্রমেই চলছে সংসারের চাকা।
মৃত্যুঞ্জয়ের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কর্ণগাঁও গ্রামের বীরেন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে তিনি। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে স্ত্রী-সন্তান, বৃদ্ধ বাবা মা ও এক ছোট ভাইকে নিয়েই পাঁচ সদস্যের পরিবার। জন্মের পর সব ঠিকঠাক ছিল তার। ১২ বছর বয়সে মাথা ব্যাথা থেকে প্রথমে এক চোখে ব্যাথা হতো। সিলেটে চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে এক পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। পরে বাম চোখের আলো হারিয়ে আস্তে আস্তে ডান চোখেরও আলো হারিয়ে একদম অন্ধ হয়ে যান। তখন অচল হয়ে পড়েন।
অভাবের তাড়নায় ছোট বেলা থেকেই মা-বাবার সাথে বাড়িতে হস্তশিল্পে জড়িয়ে পড়েন তিনি। যখন দুই চোখেরও আলো হারিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি চোখ ছাড়াই স্বপ্ন দেখেন নতুন এক জীবনের। চোখে না দেখেও শুধু অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দক্ষ হাতে বাঁশ ও বেতের কাজ শুরু করেন তিনি। তার তৈরি বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্র বিক্রি করেই চলছে তার পরিবারের জীবিকা। কঠোর পরিশ্রম আর মনের জোরেই আজ নিজের পরিবারকে টেনে নিচ্ছেন তিনি। তার এই অদম্য মনোবল ও আত্মনির্ভরশীলতা এখন অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণা।
হতদরিদ্র এই দৃষ্টিহীন মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের বাড়িতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিনি তার আপন গতিতে, নিঃশব্দে ও গভীর দরদ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে প্রতিটি কাজেই ফুটে উঠছে তার নিষ্ঠা আর ভালোবাসা। এসময় তার সাথে কথা হয় ‘রাইজিংবিডির’।
তিনি বলেন, “মূলত ঘটনা আমার মাথা ব্যাথা থেকে, যখন আমার ১২ বছর ছিলো তখন বাম চোখ নষ্ট হয়। সিলেট গেলাম চিকিৎসা করলাম-ডাক্তার বলেছিলো তোমার নষ্ট হয়েছে। ওষুধ খেয়েছিলাম কিন্তু লাভ হয়নি, এর পর ১৮ বছর বয়সে আস্তে আস্তে ডান চোখেও ধেরে ফেলে। এক সময় একেবারেই অন্ধ হয়ে যাই।”
বাঁশ ও বেতের কাজ কীভাবে কখন শিখলেন প্রশ্নের জবাবে বলেন, “এই কাজটা আমি আগেই নিজ চেষ্টায় শিখেছিলাম। পরে আমি চোখ হারানোর পর চেষ্টা চালিয়ে গেছি। কিন্তু মানুষ বলেছে আমার হাতের কাজ নাকি খুব সুন্দর হয়। কিন্তু আমার দুঃখ নিজের হাতের বানানো জিনিসপত্র নিজেই দেখতে পারি না।”
জীবনের কঠিন বাস্তবতা সঙ্গে নিয়ে দুর্বিষহ কষ্টে ভরা মৃত্যুঞ্জয়ের যাত্রা। দৃষ্টিহীন ও দারিদ্রের মতো সমস্যায় প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। এর মাঝেই যদি আরেকটি বড় বিপদ নেমে আসে। তখন জীবন যেন এক অসহনীয় বোঝায় পরিণত হয়, যেখানে বেঁচে থাকাটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তেমনই অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের জীবন।
কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, “কষ্ট এইটাই অসহায় হয়ে পড়েছি। আগের মত আর কাজ কাম করতে পারি না, শরীরে রোগে ধরেছে। অভাবের সংসার। কারো পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগীতা পাই না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া মূল্যের বাজারে বাঁশ ও বেতের তৈরির জিনিস গুলো অল্প মূল্য বিক্রি করে চলছে জীবন। এখন দাবি সরকারের কাছে সরকার যদি আমাকে সাহায্য করে তাহলে আমি একটু শান্তিতে থাকতে পারব।”
বর্তমানে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের বাঁশ ও বেতের কাজের জন্য উপজেলার আক্তাপাড়া এলাকা থেকে বাঁশ কিনে এনে কেটে কাজের উপযোগী করে দিচ্ছেন তার মা সুচিত্রা বিশ্বাস। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমার ছেলেটা অনেক কষ্টের মধ্যে পড়েছে। আগে সে একা একাই কাজ করছে, পরিবারে লোক সংখ্যাও কম ছিলো। এখন পরিবার বড় হচ্ছে কিন্তু আয় রুজি বাড়ছে না। বর্তমানে টুকরি, উড়া, ডালা বানিয়ে আর বিক্রি করে সংসার চলছে না। এর মধ্যে দিন দিন সেও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তার চলার কোনো পথই নেই। তিনি জানান আগে আগে কেউ কেউ আসছে দেখে গেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কারো সহযোগীতা পাচ্ছে না। এমনকি বন্যায় আমাদের ঘর একেবারে ভেঙে গেছে, তাও কেউ দেখেনি।”
একই গ্রামের বাসিন্দা সুশঙ্কর দেবনাথ বলেন, “আমাদের পাশের বাড়ির মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস ছেলে হিসেবে সে খুবই ভালো। কিন্তু তার চোখ দুইটা নেই। বাঁশের বেত দিয়ে কিছু কাজ করে চলে সে। তার বাচ্চাও আছে একজন। সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগীতা পায় না। আমরা চাই মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসকে যদি একটু সহযোগীতা করে সরকারে। আমাদের সবাইকে তো আল্লাহ ভালো রেখেছেন সে তো অন্ধ। তার কষ্ট দেখলে আমাদের খারাপ লাগে।”
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, “আমরা এরইমধ্যে জেনেছি, একজন অন্ধ ব্যক্তি যিনি প্রতিবন্ধিতার সত্ত্বেও বাঁশ আর বেত দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরিতে সক্ষম। তবে আর্থিকভাবে সে সমস্যায় আছে জেনেছি। আমরা যদি আবেদন পাই তাহলে আমরা সহায়তা প্রদান করব। পাশাপাশি আমরা এনজিও গুলোকেও অনুরোধ করব যে তারা যেনো প্রয়োজনে প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে।”
ঢাকা/এস