ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

দুর্গোৎসবেও ঠাকুরগাঁও কুমারপল্লীতে বিষাদের ছায়া

মঈনুদ্দীন তালুকদার হিমেল, ঠাকুরগাঁও  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আপডেট: ০৯:৫২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দুর্গোৎসবেও ঠাকুরগাঁও কুমারপল্লীতে বিষাদের ছায়া

দুর্গাপূজার মেলাকে কেন্দ্র করে হরেক রকম মাটির খেলনা তৈরির কাজ চলছে

মাটির তৈরি খেলনা বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। দুর্গাপূজার মৌসুমে একসময় কুমারপল্লীগুলো থাকত আনন্দ ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরা। কিন্তু আধুনিকতার কাছে আজ সেই শিল্প হারাচ্ছে আলো। উৎসবের দিনে যেখানে থাকার কথা ব্যস্ততা, সেখানে ঠাকুরগাঁওয়ের কুমারপল্লীতে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া ও নিস্তব্ধ হতাশা।

শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে যে হাতে তৈরি হতো রঙিন খেলনা, সেই হাতগুলো আজ ব্যস্ত শুধুই টিকে থাকার লড়াইয়ে। প্লাস্টিক ও বাজারি সামগ্রীর দাপটে কুমারদের তৈরি শিল্পকর্ম হারাচ্ছে ক্রেতা।

ঠাকুরগাঁওয়ের কুমারপল্লী ঘুরে জানা যায়, দুর্গাপূজাকে ঘিরে একসময় মাটির হাতি–ঘোড়া, গরু, হাড়ি-পাতিল কিংবা ফুলের টব নিয়ে মুখর থাকত কুমারপল্লী। শিশুদের জন্য সাজানো হতো রঙিন খেলনার ভাণ্ডার। কিন্তু এখন সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ছে না। উৎসবের আনন্দ কুমারদের জীবনে রূপ নিয়েছে দুঃখ আর অনিশ্চয়তায়।

স্থানীয় কুমাররা জানান, আগে পূজার সময় প্রচুর খেলনা বানানো হতো। এখন প্লাস্টিকের দাপটে চাহিদা কমে গেছে। যেখানে একসময় শুধু সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের পালপাড়ায় ২০০ পরিবার মৃৎশিল্পে যুক্ত ছিলেন, সেখানে আজ কাজ করছেন মাত্র ১৫–২০টি পরিবার। তাদেরও সংসার চলছে অনিশ্চয়তায়। 

কুমাররা বলছেন, উৎসবের দিনে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে তাদের জীবনে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। এই শিল্প বাঁচাতে সরকারি সহযোগিতা, সহজ ঋণ আর বাজার তৈরির দাবি জানান তারা।

ঠাকুরগাঁও পালপাড়া কুমার পল্লীর কুমার সুবল পাল বলেন, “আস্তে আস্তে আমাদের এলাকার কুমাররা অন্য পেশায় ঝুঁকে যাচ্ছে। আমরা কয়েকটি পরিবার এই পেশার সাথে যুক্ত। তবুও আমাদের তৈরি মাটির সামগ্রীর তেমন চাহিদা নেই। এই পেশায় থেকে সংসার চালানো হিমসিম হয়ে যাচ্ছে।”

অপর কুমার নিখিল চন্দ্র পাল বলেন, “পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য নিয়ে আমরা চলছি। তবে আমার সন্তান হয়তো আর আমার এই পেশায় থাকবে না। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রম করে যদি সংসারের চাহিদার যোগান দিতে না পারি, তাহলে কীভাবেই বা টিকে থাকব। পরবর্তী প্রজন্মে এই এলাকায় কোনো কুমার খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে।”

নিখিলের স্ত্রী লিমা রাণী বলেন, “সংসারের বিভিন্ন কাজ করে আবার এই মাটির সামগ্রী বানাতে বসে পড়ছি। কিন্তু এতো পরিশ্রমের কোনো ফলাফল নেই। একটা সময় ছিলো যখন কাজের মাঝে আনন্দ খুঁজে পেতাম। সেইকাজে সার্থকতা ছিল। পণ্য বাজারজাত করে হাতে অনেক টাকা আসতো। কিন্তু সেসব দিন এখন শুধু সোনালী অতীত।”

সুবাস নামের আরেক কুমার বলেন, “আগে পূজা আমাদের জন্যে ছিলো আশীর্বাদ। পূজার সময় হরেক রকম মাটির জিনিস বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। বাসার সবার জন্যে কাপড়চোপড়সহ অনেক কিছু কেনাকাটা করে হাসিমুখে বাসায় ফিরতাম। কিন্তু এখন পূজা আসলেই বাসার সবার মনখারাপ থাকে। কারণ পূজায় বাসার সবার চাহিদা মিটিয়ে কাপড়চোপড় কেনাকাটাও করতে পারি না।”

এই বিষয়ে ঠাকুরগাঁও বিসিক জেলা সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আরমান আলী বলেন, “ঠাকুরগাঁওয়ের কুমারপল্লী যেন জীবন্ত ইতিহাসের মতো এক নিদর্শন, যা রক্ষা করা জরুরি। নইলে মুছে যাবে বাংলার এক অমূল্য সংস্কৃতি। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সমন্বিত উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা এখন সময়ের দাবি।”

তিনি আরো বলেন, “কুটির শিল্পের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা এবং প্রদর্শনীতে কুমারদের তৈরি পণ্য বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”

ঢাকা/এস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়