ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্লাসিবো ইফেক্ট: শরীর ও মনের এক অসাধারণ সমন্বয় 

এস এম নাজমুল হাসান অনিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
প্লাসিবো ইফেক্ট: শরীর ও মনের এক অসাধারণ সমন্বয় 

এক দেশে ক্ষেপাটে রাজা ছিলেন। তো কী এক কারণে তিনি তার এক প্রজার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন। আর তার মৃত্যদণ্ড দেওয়া হবে সাপের কামড়ের মাধ্যমে। তো যেমন কথা তেমন কাজ। যথারীতি অপরাধীকে ধরে এনে বেধে ফেলা হলো। তার চোখও বেধে দেওয়া হলো। এবার রাজা করলেন এক অদ্ভুত কাণ্ড। তিনি সাপের বদলে দুটি সুই নিয়ে এলেন এবং আদেশ দিলেন যে সুই দুটি যেন সেই অপরাধীর পায়ে ফুটিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সে বুঝতে না পারে যে এগুলো সুই। সে যাতে ভেবে নেয় যে, সে সাপের কামড়ই খেয়েছে। 

তো রাজার কথামতো জল্লাদ সেই সুই নিয়ে অপরাধীর পায়ে ফুটিয়ে দিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো এখানেই। সুইয়ের গুতো খেয়ে ওই লোক এমন চিৎকার দিলো যে, সে মরেই গেলো সাথে সাথে। সবাই তো অবাক কেন মরল? কীভাবে মরল? কি আপনাদেরও তো প্রশ্ন এটাই যে, সে কেন মারা গেলো। আসছি উত্তর নিয়ে একটু পরেই।  

ধরুন আপনার ঘুম আসে না রাতে, নিদ্রাহীনতায় ভোগেন। এ মুহূর্তে ডাক্তারের কাছে গেলেন ডাক্তার আপনাকে ঔষধ দিলো। কিন্তু সে ঔষধেও কোন কাজ হলো না। এরপর ডাক্তার আপনাকে বললেন যে আপনার দেশি ঔষধে কাজ হবে না, বিদেশি হাই পাওয়ারের ঔষধ লাগবে এবং সেটাই তিনি এনে দিলেন। আসলে সেটা কোনো বিদেশি ঔষধই না। জাস্ট তার অফিস থেকে একটু চিনির পানি শিশিতে করে এনে দিলো। কিন্তু দেখা গেলো যে এবার আপনার ঘুম এসে গেছে। আরে অদ্ভুত তো! ঔষধ খেয়ে কিছুই হলো না, কিন্তু চিনির পানি খেয়ে কাজ হয়ে গেলো? এ কি করে সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। কী করে সম্ভব, সেসবই এখন আলোচনা করবো।

এইযে এতক্ষণ আমরা যে ব্যাপারগুলো দেখলাম, সেগুলো যতটা না পরিমান মেডিসিনের কেরামতি, তার চেয়েও বেশি যে জিনিসটা লক্ষ করার মতো, তা হচ্ছে মানসিক অবস্থা। আর এইরকম সিচুয়েশনকে আমরা ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’ বলতে পারি।

প্লাসিবো ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে- I shall Please, অর্থাৎ, ব্যাপারটা সন্তুষ্টির সাথে জড়িত। প্লাসিবো (Placebo) হচ্ছে এমন এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি কিংবা ঔষধ, যার আসলে কোনো ঔষধী গুণাগুণ নেই; কিন্তু তারপরেও সেটা রোগীর উপরে কাজ করে।তার মানে হচ্ছে রোগীর সম্পূর্ণ অজান্তে তাকে এমন এক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পরিচালনা করা হয় যেখানে তার ঔষধের চেয়েও সবচেয়ে বেশি কাজ করে মানসিক দৃঢ়তা। সহজভাবে বললে, প্লাসিবো এমনভাবে মানসিক অবস্থা তৈরি করে, ফলে রোগীর মনে হয় তার রোগ সেরে যাচ্ছে।

একজন সুস্থ সবল মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত শক্তিশালী। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় মানসিক দৃঢ়তা এবং আত্নবিশ্বাস এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। দেখা যায় আত্নবিশ্বাসের ফলে অনেক সময় মানুষের ছোট খাটো অসুখ বিসুখ সেরে যায়। আবার অনেক ছোট খাটো অসুখও মানসিক দূর্বলতার কারণে এক বড় সমস্যায় পরিণত হয়। তাই বলে ইমিউনো সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কি মস্তিষ্কের সাথে সম্পর্কযুক্ত? হ্যাঁ অবশ্যই কিছুটা সম্পর্ক আছে। কারণ মানুষের শরীর আর মন একে অপরের পরিপূরক। মস্তিষ্ক আমাদের মানসিক অবস্থার পরিচালনা করে।তবে প্লাসিবোর প্রভাব ব্যাক্তিবিশেষে কমবেশি হতে পারে। 

প্লাসিবোর ক্ষেত্রে আমরা মেডিসিন হিসেবে যেসব ব্যাবহার করি সেগুলো মূলত আমাদের মস্তিষ্ককে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ব্যাবহার করা হয়। মস্তিষ্ক ভেবে নেয় তাকে মেডিসিন দেওয়া হয়েছে তার মানে সে সুস্থ। তখন যে স্বাভাবিকভাবেই কিছু এনজাইম এবং হরমোন নিঃসরন করে। (এন্ডোক্যানাবিনয়েডস অথবা এন্ডজেনাস অপিওয়েডস হরমোন এবং আরো কিছু পদার্থের উপস্থিতি প্লাসিবো প্রভাবকে প্রভাবান্বিত করে)। মস্তিষ্ক সুস্থ মানে শরীর সুস্থ। এক্ষেত্রে কিছু ছোটখাটো শারীরিক অসুখ যেমন পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, অনিদ্রা, রুচি সমস্যা, হতাশা এসব সুস্থ হয়ে যায়। শুধুমাত্র মস্তিষ্ককে বুঝাতে পারলেই হবে যে মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। কোনোভাবে যদি সে টের পায় যে তাকে ভুলভাল বোঝানো হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আর প্লাসিবো কাজ করবে না। 

পারকিনসন ডিজিজ, বিষন্নতাসহ বিভিন্ন রোগে ব্যথানাশক হিসেবে প্লাসিবোর ব্যবহার নিয়ে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমেরান মেয়ার, জোহানা জারকো এবং ম্যাট লিবারম্যান মস্তিষ্ক ইম্যাজিং পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, প্লাসিবোর প্রভাব সত্যিকার অর্থেই মস্তিষ্কের গঠনে লক্ষ করার মতো পরিবর্তন আনে। প্লাসিবো শরীরের গাঠনিক বেশ কিছু পরিবর্তন যেমন হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও মস্তিষ্কের রাসায়নিক কার্যক্রমের পরিবর্তনের ভূমিকা রাখে।

এখন আসি প্রথমেই যে রাজার আর অপরাধীর কথা বলেছিলাম সেখানে। অপরাধীকে সুচ ফুটানোর কারণে সে ভেবেছিল তাকে সাপেই কামড়েছে। তাই মৃত্যুভয় এবং সাপের কামড় দুইয়ে মিলে তার মস্তিষ্ক ধরেই নিয়েছে যে সাপের কামড় খেয়েছে এবং তার মৃত্যু হচ্ছে। আর এতেই মস্তিষ্ক ভুল ভেবে ভয়ে আতঙ্কে তার কর্মকান্ড অফ করে। ঠিক যেমনটা দেখলাম পরবর্তীতে ঘুমের ঔষধের ক্ষেত্রে। সেখানে আপনাকে যখনই বিদেশি ঔষধের কথা বলা হলো আপনি ভাবলেন খুব হাই পাওয়ারের ঔষধ এবার ঘুম আসবেই। আপনার মস্তিষ্ক ও এটাই ভেবে নিয়েছে। আর তাতেই আপনার ওই চিনির পানি খেয়ে ঘুম এসে গেছে। 

শেম সার্জারি নামে এক ধরনের সার্জারি আছে, যেখানে শুধু রোগীকে ভুল বুঝানোর জন্য একটা কাটাছেড়া করে সার্জারি করা হয়, যাতে রোগী ভেবে নেয় যে তার সার্জারি হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়, তবে রোগী বুঝে গেলে কোনো কাজ হবে না। তবে প্লাসিবো ইফেক্ট বড়সড় কোনো রোগ যেমন ক্যান্সার, এইডস, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে তেমন কোনো কাজে আসবে না। শুধু ছোটখাটো অসুখই এর মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যাবে।

বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যার খোঁজ পেয়েছেন ষোড়শ শতাব্দীতে। ওই সময় প্রচুর আছর হওয়া রোগীর সন্ধান পাওয়া যেত। খৃস্টান পুরোহিতরা বাইবেল, ক্রুশ, আর হোলি ওয়াটারের সাহায্যে জিনের আছর হওয়া মানুষদের দেহ থেকে শয়তান তাড়াতেন। কিছু যুক্তিবাদী লোক আছর হওয়া লোকদের সামনে ভুয়া ক্রুস, ভুয়া বাইবেল আর ভুয়া হোলি ওয়াটার এনে জিন ঝাড়া শুরু করলো। দেখা গেলো, রোগীদের ঘাড় থেকে জিন বা ভূত চলে যাচ্ছে, রোগীরা সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে ওই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন যে ক্রুশ, বাইবেল, কিংবা হোলি ওয়াটার এর কোনো ভূমিকা নেই জিন তাড়ানোয়। প্রস্রাবের পানি, অশ্লীল বই, কিংবা বাঁকাত্যাড়া যে কোনো লাঠি দিয়েই যদি রোগীর মনে সেই আমেজ বা অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারি, তাহলে তার ঘাড় থেকে জিন বা শয়তান চলে যাবে। (প্রকৃতপক্ষে এই জিনের আছরগুলো মূলত হিস্টেরিয়া কিংবা সিজোফ্রেনিয়া রোগ)।

শরীরের সাথে মনের একটি সরাসরি যোগাযোগ আছে বলেই ডাক্তাররা আজকাল প্লাসিবো পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে থাকেন। তবে এটি সবক্ষেত্রে কাজ করে না। নেতিবাচক কিছু পর্যায়ও দেখা যায়। একে বলা হয় ‘নোসিবো ইফেক্ট’।

প্লাসিবো ইফেক্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অমীমাংসিত অধ্যায়। এটি নিয়ে নানা তর্ক রয়েছে, বিতর্ক রয়েছে। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে চিকিৎসকরা এখনো বিস্ময় প্রকাশ করেন। এর মূল কারণ এখনো কেউ ধরতে পারেননি। তাই এটিকে কেউ তেমনভাবে সুপারিশ করেন না। মানুষের মনের সাথে শরীরের যে সম্পর্ক সেটাকে ব্যবহার করেই মূলত প্লাসিবো কাজ করে যাচ্ছে।  

লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

গোপালগঞ্জ/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়