ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইতিহাসের একটি অধ্যায় আহসান মঞ্জিল  

মো. মনির হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ১৫ মার্চ ২০২১  
ইতিহাসের একটি অধ্যায় আহসান মঞ্জিল  

পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষা ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ, যা বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম জাদুঘরে পরিণত হয়েছে।  

প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন এই ঐতিহাসিক স্থানে। কথা বলছিলাম শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিল নিয়ে।

এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। ১৮৫৯ সালে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পথ শুরু আহসান মঞ্জিল থেকেই। এখান থেকেই ১৯০৬ সালে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। 

আহসান মঞ্জিলের শুরুটা যেমন ছিল

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থান রঙমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে তার ছেলে শেখ মতিউল্লাহ রঙমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুঠি হিসাবে এটি দীর্ঘ দিন পরিচিত ছিল। এরপর ১৮৩০ সালে বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গণির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি কিনে বসবাস শুরু করেন। 

এই বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আবদুল গণি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশল-প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেন। যার প্রধান ইমারত ছিল আহসান মঞ্জিল। ১৮৫৯ সালে নওয়াব আবদুল গণি প্রাসাদটি নির্মাণ শুরু করেন, যা ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। তিনি তার প্রিয় ছেলে খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন ‘আহসান মঞ্জিল’। ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রঙমহল ও পুরাতন ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল।

নতুনরূপে আহসান মঞ্জিল

১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্থ আহসান মঞ্জিল পুনর্নির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। পুনর্নির্মাণ ও মেরামতের জন্য রাণীগঞ্জ থেকে উন্নতমানের ইট আনা হয়। মেরামতকর্ম পরিচালনা করেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। সেই আমলে ঢাকা শহরে আহসান মঞ্জিলের মতো এত জাঁকালো ভবন আর ছিল না। এর প্রাসাদোপরি গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা বহুদূর থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।

দ্বিতীয় বারের মতো ১৮৯৭ সালে ১২ জুন ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এ মঞ্জিলের দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবত খানাটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে নবাব আহসানুল্লাহ তা পুনঃনির্মাণ করেন। ১৯৫২ সালে জমিদারী উচ্ছেদ আইনের আওতায় ঢাকা নওয়াব এস্টেট সরকার অধিগ্রহণ করে। কিন্তু নওয়াবদের আবাসিক ভবন আহসান মঞ্জিল এবং বাগানবাড়িসমূহ অধিগ্রহণের বাইরে থাকে। কালক্রমে অর্থাভাব ও নওয়াব পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে যাওয়ায় আহসান মঞ্জিলের রক্ষণাবেক্ষণ দুরূহ হয়ে পড়ে।

এক নজরে আহসান মঞ্জিলের ভেতরের পরিবেশ

এই প্রাসাদের ছাদের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। একইভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দু’টি মনোরম তোরণ আছে যা সবচেয়ে সুন্দর। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরে দু’টি অংশ আছে। বৈঠকখানা ও পাঠাগার আছে পূর্ব অংশে। পশ্চিম অংশে আছে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। নিচতলার দরবারগৃহ ও ভোজন কক্ষ রয়েছে।

প্রাসাদের বাইরের সোন্দর্য

প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একতলার সমান উঁচু করে গাড়ি বারান্দা। দক্ষিণ দিকের গাড়ি বারান্দার ওপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিঁড়ি সম্মুখের বাগান দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। প্রাসাদের উভয় তলার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলানসহযোগে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা ও কক্ষগুলোর মেঝে মার্বেল পাথরে শোভিত। 

গম্বুজের সোন্দর্যে আহসান মঞ্জিল আলোকিত

আহসান মঞ্জিলের গম্বুজটি নির্মাণের জন্য প্রথমে নিচতলার বর্গাকার কক্ষটির চারকোণায় ইট দিয়ে ভরাট করে গোলাকার রূপ দেওয়া হয়েছে। এর উপর দোতলায় নির্মিত অনুরূপ গোলাকার কক্ষের ঊর্ধ্বাংশে স্কুইঞ্চের মাধ্যমে ছাদের কাছে কক্ষটিকে অষ্টভূজাকৃতির করা হয়েছে। এই অষ্টকোণ কক্ষটিই ছাদের উপর গম্বুজের পিপায় পরিণত হয়েছে। 

পরিশেষে অষ্টবাহুর মাথাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে ক্রমে হেলিয়ে চূড়াতে নিয়ে কুমদ্র কলির আকারের গম্বুজটি তৈরি করা হয়েছে। ভূমি থেকে গম্বুজ শীর্ষের উচ্চতা ২৭ দশমিক ১৩ মিটার। গম্বুজের সোন্দর্য দর্শনার্থীদের মন ছুঁয়ে যায়। আহসান মঞ্জিলের প্রতিটি কক্ষ ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।

রঙমহলের ৩১টি কক্ষের ২৩টিতে প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়েছে। ৯টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত ও মি. ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা ও ক্রোকারীজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র ও নওয়াব এস্টেটের পুরনো অফিস এডওয়ার্ড হাউজ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছে। 

এছাড়া এই আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি ও সমসাময়িককালের সাদৃশ্যপূর্ণ নিদর্শনাদি ক্রয় ও সংগ্রহ করে গ্যালারিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এ যাবৎ সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা মোট ৪০৭৭টি।

পুরান ঢাকার ইতিহাস সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনে আহসান মঞ্জিলের ভূমিকা অতুলনীয়। বর্তমান সময়ে মুক্ত পরিবেশে আড্ডা দেওয়ার উৎকৃষ্ট স্থানে পরিণত হয়েছে। আহসান মঞ্জিল ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নতুন প্রজন্মের জন্য আহসান মঞ্জিল হতে পারে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়