ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা’

আহসান হাবীব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:০১, ২ ডিসেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২০:২৩, ২ ডিসেম্বর ২০২৩
‘ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা’

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আজ শনিবার সকাল ৯টা ৩৫মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্পের খবর পাওয়া গেছে। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ভাদুর ইউনিয়নের হানুবাইশ গ্রামে ভূকম্পন উৎপন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

কম্পনটি ৫.৬ রিখটার স্কেল মাত্রা ও মাঝারি আকারের ছিলো। কম্পনের ফলে ইতোমধ্যে বেশকিছু এলাকার ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক উঁচু ভবনের কাত হওয়া, দেয়াল ও ছাদের ফাটল তৈরি হওয়া এবং কাছাকাছি একটি পুকুরের পাড় ধসে পড়া। ফলে দেশব্যাপী বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

ভূমিকম্প নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও গবেষক অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, আমাদের ভূ-অভ্যন্তরে তথা মাটির গভীরে যে ফাটল থাকে, সেই ফাটলের মধ্যে টেকটোনিক প্লেটের মুভমেন্টের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভাবে যে শক্তি সঞ্চিত হয়। এই শক্তির পরিমাণ যখন ওই ফাটল এর নিকটবর্তী মাটি বা পাথরের শক্তি ধারণ ক্ষমতাকে অতিক্রম করে যায় তখন এই অতিরিক্ত শক্তি কম্পন আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিষয়টিই ভূকম্পন বা ভূমিকম্প হিসেবে অনুভূত হয়। আজকের ভূমিকম্পটিও সেরকমই মাটির নিচের ছোট্ট কোন ফাটল বা ভূতত্ত্বের ভাষায় অ্যাক্টিভ ফল্ট বরাবর অতিরিক্ত শক্তি রিলিজ হওয়ার কারণে সংঘটিত হয়েছে।

আমাদের অন্যান্য যে অঞ্চলগুলো রয়েছে তন্মধ্যে সিলেট, চট্টগ্রামে এরকম বেশ‌ কয়েকটি অ্যাকটিভ ফল্ট রয়েছে। এরকম ফল্টগুলোতে প্রতিনিয়ত শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশ ইন্ডিয়ান প্লেটের একটা অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেটের উত্তর-পূর্ব অংশে আমাদের অবস্থান। ইন্ডিয়ান প্লেটের উত্তর দিকের অংশটাকে আমরা বলি ইউরেশিয়ান প্লেট, এবং পূর্বদিকে বার্মিজ প্লেট। ইন্ডিয়ান প্লেট এই দুটি প্লেটকে সর্বদাই উত্তর-পূর্ব দিকে কোন বরাবর ধাক্কা দিচ্ছে। এই ধাক্কার কারণে সর্বদাই শক্তি পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এই শক্তির পরিমাণ যখন একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে তখনই সেই অতিরিক্ত শক্তি কম্পন আকারে রিলিজ হয়, তথা ভূমিকম্পের সূচনা হয়।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিলো ৫.৬। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পের মাত্রা ৫.৫। ইন্ডিয়ান সিসমোলজিক্যাল সোসাইটি জানিয়েছে এটি ছিলো ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প। অর্থাৎ ভূমিকম্পটি ৫.৫ থেকে ৫.৮ মাত্রার মধ্যে ছিলো।

তবে আজকের ভূমিকম্পটি মাটির ঠিক কত গভীরে থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে সেটি এখনো ক্লিয়ার ভাবে জানা যায়নি, সেটি হয়ত আগামী ১ থেকে ২ দিনের ভিতরে জানা যাবে।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে ভূমিকম্পেটি মাটির ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি গভীর থেকে এবং ইউএসজিএস জানিয়েছে মাটির ১০ কিলোমিটার গভীর থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।

এবারের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি লক্ষণীয় মাত্রায় ঘটেনি। তবুও পূর্ব সতর্কতা ও সঠিক পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন জাবি অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, কোনো একটি জায়গায় ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সেখানকার ভূমিকম্পের প্রভাব কেমন হবে সেটি নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর। সেগুলো হলো- ভূমিকম্পটি কত মাত্রার, ভূমিকম্পের উৎস থেকে দূরত্ব এবং মাটির কত গভীরে এর উৎস।

ঢাকা থেকে রামগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। উৎস থেকে দূরত্ব বেশি হওয়ায় ঢাকায় আজকের ভূমিকম্পের প্রভাব তুলনামূলক কম ছিলো। আর যেহেতু ভূমিকম্পটি মাটির ১০ থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার গভীর থেকে অর্থাৎ বেশ গভীরে থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে তার কারণে প্রভাব তুলনামূলক কম হয়েছে। যদি ভূমিকম্পের উৎস ঢাকার আরো নিকটবর্তী স্থানে হতো বা তুলনামূলক কম গভীরে উৎপন্ন হতো, তাহলে আরো বেশি কম্পন অনুভূত হতো এবং বেশ ক্ষয়ক্ষতি হতে পারতো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।

তার মতে, যেহেতু আমাদের দেশের অবস্থান ইন্ডিয়ান প্লেট বাউন্ডারির নিকটবর্তী সেহেতু এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশ ভূমিকম্প প্রবণ ছিলো এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে যে জনবহুল ঢাকা শহরের জন্য এটি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু ঢাকা শহরের অবস্থান সেরকম কোনো মেজর অ্যাক্টিভ ফল্টে নিকটবর্তী না, সেহেতু সে রকম বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কম। তারপরেও আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে এবং ভূমিকম্প সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের করনীয় সম্পর্কে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

তিনি বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য প্রতিটি দিক বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ভূমিকম্প পরবর্তী প্রস্তুতি এবং দুর্যোগ প্রতিক্রিয়ার কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ভূতাত্ত্বিক, প্রকৌশলী এবং দেশের অন্যান্য সমস্ত বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সম্প্রদায়ের উচিত, বাংলাদেশের ভূকম্পন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সমস্ত বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য যৌথ প্রচেষ্টা চালানো।

আমাদের এই অঞ্চলটি একটি ভূমিকম্প প্রবণ। অতীতেও ভূমিকম্প, বর্তমানেও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তাই এটা নিয়ে এত বেশি প্যানিকড হওয়ার কিছু নাই। যেহেতু এখনো আমরা ভূমিকম্প নিয়ে আগে থেকে বলার মত প্রযুক্তি এখনো তৈরি করতে পারিনি। তাই আমরা বলতে পারবো না যে কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে এবং কবে হবে। কিন্তু আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যে ভবনগুলো নির্মাণ করছি বা করব সেগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করেই তৈরি করতে হবে।

অধ্যাপক বলেন, জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকম্প নিয়ে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে, সেই কাজগুলোকে আরেকটু সমন্বয় করার সুযোগ আছে। গবেষণার যে ফলগুলো‌ আসছে, সেগুলো একসঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কৌশল তৈরি করার ক্ষেত্রে আমরা জোর দিতে পারি।

ভূমিকম্পের প্রভাব হ্রাসে কি করণীয় জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফসানা হক বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমিকম্পের ক্ষতি প্রতিরোধ করতে আমাদের কঠোরভাবে কার্যকর ভূমিকম্প নিরাপত্তা নির্দেশিকা প্রয়োগ করতে হবে। বিস্তারিত ভূতাত্ত্বিক তদন্ত চালাতে হবে এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধী উপকরণ ও কৌশল ব্যবহার করতে হবে। জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। আমাদের আপদকালীন পরিকল্পনাও প্রস্তুত রাখতে হবে এবং সম্ভাব্য ভূমিকম্পের প্রভাব হ্রাস করতে অবকাঠামোগত স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করতে হবে।

/মেহেদী/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়