ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘আমার মানিক দুটোর আগে বাঁচাও’

রফিক সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ১১ মে ২০২৫   আপডেট: ১৬:০২, ১১ মে ২০২৫
‘আমার মানিক দুটোর আগে বাঁচাও’

রফিক সরকার

আমার মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। তবে নামের চেয়ে বড় ছিল তাঁর পরিচয়—তিনি ছিলেন মা, আমার পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। মা—শুধু একটি শব্দ নয়, ছিল আমার আত্মার সবচেয়ে গভীর অনুভব।

ছোটবেলায় আমি মাকে দেখতাম সকাল থেকে রাত শুধু আমাদের জন্য খেটে চলেছেন। নিজের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-স্বপ্ন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তিনি আমাদের মুখের একটুখানি হাসির জন্য জীবনকে সহজ করে তোলার চেষ্টা করতেন। তার ঠোঁটে লেগে থাকত লাল রঙের পান, আর সেই পানের দাগ মাখা হাসি। আমার কাছে মনে হত, যেন শত দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যেও এক পৃথিবী শান্তির আলো।

আরো পড়ুন:

তবে মা কেবল নরম-স্নিগ্ধ ছিলেন না, ছিলেন কঠিন এক পাহাড়ের মতো দৃঢ়। সেটা বুঝেছিলাম ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়।

সেদিনকার কথা আজও ভুলিনি। ছোট বেলায় আমি ছিলাম একটু নাদুস-নুদুস। যে কারণে অনেকের গাল টিপুনি খেতে হতো। সবাই অনেক আদর করতো। বন্যার দীর্ঘতায় পাশের প্রতিবেশী আমাকে দেখতে চাইলেন। মা, আমাকে কপালের এক কোনে কাজল দিয়ে কালো ফোঁটা দিয়ে সাজিয়ে নিল।

মা, আমি আর আমার বড় বোন বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা তখন কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে ছিলাম। স্রোত এতটাই তীব্র ছিল যে একটা ভুল পা ফেললেই মানুষ গাছের মতো ভেসে যেত। আমরা তিনজন হঠাৎ স্রোতের ধাক্কায় ভেসে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই মা শেষ চেষ্টা করে আমাদের আঁকড়ে ধরলেন, আর চিৎকার করে বলছিলেন, “ভাই, আমার মানিক দুটোর আগে বাঁচাও! আমি থাকলাম না থাকলাম, তাতে কী হইল!”

সে সময় এক দূর সম্পর্কের চাচা পাশে ছিলেন। মা তাকে বলেননি, যেন তাকে আগে টানেন। বলেছিলেন তার দুটো সন্তানের জীবন আগে রক্ষা করতে। আমি আজও ভাবি, কতটা ভালোবাসলে একজন মানুষ এমনভাবে নিজের জীবন পিছনে ফেলে অন্যের জন্য সামনে এগিয়ে দিতে পারেন।

আমাদের বাঁচানো হয়েছিল, মা নিজে তখন কিছুটা আহত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও তার মুখে ছিল সেই চেনা হাসিটা। বলেছিলেন, “তোমরা আছো, তাই তো আমি এখনো বেঁচে আছি।”

মা ছিলেন আমাদের সংসারের প্রাণ। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে আমি মাকে বিরক্ত করতাম, গাইতাম, হেসে বলতাম, “মা, দাও না, একটুখানি হাসি দিলে তো তুমি হারিয়ে যাবে!”

আর তিনি হেরে যেতেন, ভালোবেসে সব দিয়ে দিতেন। মার আঁচলের গাঁট ছিল যেন এক জাদুর থলে। কখনো লুকিয়ে টাকা-পয়সা বের করে নিয়েছি, আবার ধরা পড়লে শুধু হাসতেন। বলতেন, “তুই না নিলে কে নেবে রে!”

তবে কখনো সেই গাঁট ফাঁকা থাকলে মা নিজের মনেই দুশ্চিন্তায় পড়তেন, “এই কাজ নিশ্চয় আমার ছেলে করেনি। তবে কে করল?”

এই সহজ-সরল, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মানুষটি আজ আর আমার পাশে নেই। মা পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে, কিন্তু আমার ভেতরের একেকটা নিঃশ্বাসে তিনি রয়েছেন।

আজো যখন কোনো নাটকে, সিনেমায় বা গানে মায়ের প্রসঙ্গ আসে, আমি থেমে যাই। চোখ ভিজে যায়। মায়ের কথা উঠলেই আমি আবার শিশুর মতো কাঁদি। মায়ের কাছে আমার সব আবদার ছিল স্বাভাবিক। কিছু না চাইলেও মা বুঝে যেতেন, আজ আমার কিছু একটা দরকার আছে।

এখনো, কষ্ট পেলে মনে হয়, যদি মা থাকতেন! তার কোলের মতো আর কোথাও এত শান্তি আমি খুঁজে পাই না। মা ছিলেন আমার জীবনের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। আজ তিনি নেই, কিন্তু আমি জানি, আমার প্রতিটি ভালো কাজের মধ্যে, প্রতিটি হাসির মাঝে, মায়ের ছোঁয়া আছে।

মা, তুমি নেই। কিন্তু তোমার জন্যই আমি আজো আছি। তোমার ছায়া এখনো আমার ওপর রয়ে গেছে। আমার জীবন জুড়ে, আমার সমস্ত অস্তিত্বে।

(লেখক: গণমাধ্যমকর্মী)

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়