ইবির সাজিদ হত্যা: জড়িতদের গ্রেপ্তারে প্রশাসনের এখতিয়ার নিয়ে আইন কী বলে?
তানিম তানভীর, ইবি || রাইজিংবিডি.কম
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থী সাজিদ হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের জোরাল দাবি তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষক নেতৃত্ব আল্টিমেটাম দিয়ে সোচ্চার হলেও আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই গ্রেপ্তারের এখতিয়ার রাখে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে সাজিদের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। না হলে ওইদিন উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি কাউকে গ্রেপ্তার করে বিচার করতে পারে? আইন কী বলে?
সাজিদ হত্যায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই চাপ দেওয়া হচ্ছে। আসামি ধরতে প্রশাসনকে চাপ দেওয়ার আড়ালে অন্য কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বানও রয়েছে সচেতন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে।
আইনগত সূত্রে, ‘দণ্ডবিধি ১৮৬০’-এর ধারা ২৯৯-৩০৪ অনুযায়ী, ‘হত্যা একটি গুরুতর এবং রাষ্ট্রদণ্ডযোগ্য অপরাধ। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্পূর্ণই পুলিশের দায়িত্ব। (যদি বিশেষ কোনো অঞ্চল বা সংস্থা না থাকে)।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারা অনুযায়ী, পুলিশ হত্যা মামলার এফআইআর গ্রহণ করে। ধারা ১৫৬ ও ১৫৭ অনুযায়ী পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এ অপরাধ আমলযোগ্য হওয়ায় ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী, পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে। এক্ষেত্রে র্যাব সহায়তা করতে পারে কিন্তু মামলার আইনগত দায় পুলিশের।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬, ২৯ ও ১৯৩ ধারা অনুযায়ী, হত্যার বিচার করার এখতিয়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অথবা মহানগর দায়রা জজ আদালতের (যদি ঘটনাটি মহানগর এলাকায় হয়)। এক্ষেত্রে উচ্চআদালত শুনানি ও আপিল (আপিল/রিভিশন) পর্যায়ে যুক্ত হয়। পুলিশ প্রতিবেদন (চার্জশিট) জমা দেওয়ার পর মামলাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চলে যায়।
গত ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পুকুর থেকে সাজিদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ভিসেরা রিপোর্ট অনুযায়ী তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।
এ ঘটনায় আইনগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনার ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং তদন্ত কমিটি গঠন, হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে পুলিশকে সহায়তা, শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থাস্বরূপ জড়িতদের বহিষ্কার বা সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে। তবে হত্যার মামলায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার বা বিচার করার এখতিয়ার প্রশাসনের নেই।
জানা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর প্রশাসন চত্বরে সাজিদ হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করে শিক্ষার্থীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক নেতারা মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করেন। এসময় সাজিদ হত্যায় জড়িতদের আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রেপ্তার করতে না পারলে ভিসির কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের গ্রেপ্তারি এখতিয়ার আছে কি না- জানতে চাইলে আইন বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদা আক্তার বলেন, “বিচারাধীন বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেয়। তদন্তাধীন বিষয়ে অন্য পক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে না। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই গ্রেপ্তার করতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করতে পারে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অধ্যাপক জানান, তদন্তাধীন বিষয়ে ইনফরমেশনও পাবলিশ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ডটা পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ন্যস্ত। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ একরের মধ্যে ফৌজদারি অপরাধ হলে প্রশাসন সর্বোচ্চ তাকে ধরে পুলিশে দিতে পারে। সন্দেহভাজন কাউকে পেলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে গ্রেপ্তার দেখাতে পারে পুলিশ। হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার রাষ্ট্রপক্ষের কাজ। তবে তদন্তকারী সংস্থাকে তদন্তের কাজে সহযোগিতা ও তদারকিতে প্রশাসনের দায় আছে। কিন্তু এর জন্য জড়িতদের গ্রেপ্তার করার দাবি নিয়ে ভিসি কার্যালয় ঘেরাও করার পরিকল্পনা সন্দেহজনক। প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাঁধাগ্রস্ত করে কোনো ফায়দা লুটতে কেউ সাজিদ ইস্যুকে ট্রামকার্ড হিসেবে নিয়েছে বলে মনে হয়।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্ট্রার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, “ফৌজদারি মামলায় কগনিজেবল (আমলযোগ্য) অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ধরে পুলিশে দিতে পারে।”
ঝিনাইদহের (মহেশপুর) সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ওয়াজিদুর রহমান বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুটি ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে আটক করতে পারে। প্রথমত, সন্দেহভাজন; পরে তাকে মামলার ট্যাগিং দিয়ে। দ্বিতীয়ত, সরাসরি কারো নাম চলে এলে আটক করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটিতে যেহেতু সন্দেহভাজন কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি, সেহেতু প্রশাসন কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না। একমাত্র তদন্তকারী সংস্থাই পারবে গ্রেপ্তার করতে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারে।”
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, “বিচারাধীন বিষয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রেপ্তার করতে পারে না। এটা তো একটা বাচ্চা মানুষও বোঝার কথা। এখন এ বিষয়কে সামনে নিয়ে আমাকে ১০ ঘণ্টাও ঘেরাও করে রাখলে আমি কী করতে পারি? আমি সকলকে নিয়ে সিআইডি বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেতে পারি, সাজিদের পরিবার যদি সিআইডির ওপর আস্থা রাখতে না পারে তাদেরকে পিবিআইয়ের কাছে তদন্তভার দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারি। আর জড়িতদের চিহ্নিত করতে প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে পারি। আমরা সেটা করছি।”
এদিকে পাঁচ মাস পার হলেও এখনো সাজিদ হত্যায় জড়িতদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সাজিদ আব্দুল্লাহ হত্যা ইস্যুতে তদন্ত করছে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। দায়িত্ব গ্রহণের ৯৩ দিন পার হলেও হত্যাকারী শনাক্তে কোনো ধরনের আশার আলো দেখাতে পারেনি তারা। তদন্তের বিষয়ে সাংবাদিক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিন দফায় ব্রিফিং করলেও উল্লেখযোগ্য তথ্য দিতে পারেনি সিআইডি।
ঢাকা/রাসেল