ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নতুন শিক্ষা কাঠামো, যা বললেন শিক্ষাবিদ-শিক্ষক-অভিভাবকরা

হাকিম মাহি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:০৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
নতুন শিক্ষা কাঠামো, যা বললেন শিক্ষাবিদ-শিক্ষক-অভিভাবকরা

ফাইল ছবি

২০২৩ সাল থেকে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা থাকছে না। নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো কোনো বিভাগ থাকছে না।  এই নতুন শিক্ষাপদ্ধতি পুরোপুরি চালু হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।  সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যে আশার আলো দেখছেন অনেকেই। এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। তবে, পরীক্ষা পদ্ধতি রেখে জিপিএকে বাদ দিয়ে আরও সহজ করার অভিমত দিয়েছেন অনেকে। 

নূরজাহান পড়াশোনা করছে মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  মা শাকিলা আক্তার মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা থাকছে না- এটা শুনে তিনি বলেন, পরীক্ষা রাখা প্রয়োজন। কেননা শিক্ষার্থীদের মাঝে তখন একটা উদ্দীপনা এবং উৎসাহ কাজ করে পড়াশোনার জন্য।  কিন্তু জিপিএ বিষয়টাকে বাদ দেওয়া প্রয়োজন। জিপিএ নিয়ে একটা নষ্ট প্রতিযোগিতা চলে সবার মাঝে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক চাপ তৈরি হয়।  তাই পরীক্ষা নেওয়া হলেও জিপিএ যেন না থাকে৷

আনুশকা সারাহ্জাবীন পড়ছে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল, জাহানাবাদ, খুলনায় পঞ্চম শ্রেণিতে।  তার মা মৌসুমী সুলতানা জানান, তিনি যেমন পরীক্ষা পদ্ধতি রাখতে চান, আবার বাচ্চাদের পরীক্ষা যে ভীতি, সেটা থেকেও মুক্তি চান।

তিনি বলেন, এই পরীক্ষাগুলোর কারণে বাচ্চাদের ভেতরে একটা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হতো।  যে কারণে ভবিষ্যতেও তারা উপকৃত হবে। কিন্তু আসলে এগুলো একটা বাচ্চার মাথায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। বাচ্চাদের মানসিক অবসাদগ্রস্ত করে ফেলে। তাই, চাপ কমিয়ে একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নিলে ভালো হয়। যদি সুষ্ঠু প্রক্রিয়া না আনা যায়, তাহলে পরীক্ষা বাদ দেওয়াই ভালো। 

পিইসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে নরসিংদীর মনোহরদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে সাজিদুল ইসলাম। তার বড় ভাই মোস্তাকিম ফারুকী পড়াশোনা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে। তার মতে, প্রতিযোগিতামূলক বিষয়গুলো সবসময়ই ছাত্রছাত্রীকে আকৃষ্ট করে। কারণ, এখানে সুযোগ থাকে নিজেকে বেস্ট প্রমাণ করার। এতে করে তারা পড়াশোনায় মনোযোগী হবে, নিজেকে যাচাইয়ের জন্য তাদের নতুন নতুন শেখার আগ্রহটা বেড়ে চলবে।  তাই পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা হওয়া জরুরি।

তিনি আরও বলেন, ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বিভাগ না থাকাটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।  কেননা এতে সব শিক্ষার্থী সব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে এবং তাদের মধ্যে কোনো হীনমন্যতা থাকবে না। এসএসসির পর তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কে কোন বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করবে।

এদিকে, পিইসি পরীক্ষা না রাখাকে ভালো দিক বলেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিতের শিক্ষক মো. ইমরান নাজির। 

তিনি বলেন, পিইসি পরীক্ষা না রাখা একটি ভালো সিদ্ধান্ত।  তবে, জেএসসি পরীক্ষাটা থাকলে ভালো হতো (যেমন বিশ্বকাপ খেলার আগে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা হয় সেখানকার কন্ডিশন বোঝার জন্য)। তাহলে এসএসসি পরীক্ষার ভীতি শিক্ষার্থীদের অনেকাংশে কমে যাবে। 

ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মাঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিক্ষাক্রম নির্দিষ্ট সময় পরে যুগের চাহিদা অনুসারে পরিবর্তন করা হয়। দেশে দেশে শিক্ষাক্রমের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। প্রত্যেক বিষয়ের সুবিধা-অসুবিধা দুটি দিকই থাকে। আমি নতুন এই শিক্ষাক্রমকে সাধুবাদ জানাই। উন্নত দেশগুলোতে বহু আগেই এ ধরনের শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আমাদের দেশেও এটা দরকার বলে মনে করি। তবে, এ ধরনের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেধাবী শিকক্ষের প্রয়োজন। যেটা আমাদের দেশে ঘাটতি রয়েছে। এই সংকটের সমাধান করতে পারলে, এই শিক্ষাক্রম বর্তমান শিক্ষাক্রমের চেয়ে ফলপ্রসূ হবে।

তানজিলা খাতুন, খুলনার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক।  তিনি পিইসি, জেএসসি পরীক্ষা রাখার বিষয়ে মত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিইসি, জেএসসি আর ৯-১০ এ গ্রুপগুলোর একটা গুরুত্ব আছে। দেশে এখনো অনেক জায়গা আছে, যেখানে শিক্ষার ভীত মজবুত নেই। কিন্তু পিইসি পরীক্ষা দেওয়ার কারণে হলেও দেখা যায় অনেক বাচ্চাকাচ্চা ভীতটা মজবুত করতে চায়।  এটা একটা প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে, আর এতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায় নিঃসন্দেহে। 

আবার জেএসসি পরীক্ষার সাথে নবম-দশমের গ্রুপের একটা যোগ আছে।  জেএসসিতে ফলাফল দেখেই গ্রুপ নির্ধারণ করে আর এমন অনেকেই আছে, যারা এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে পরবর্তী সময়ে পলিটেকনিক বা কারিগরিতে গিয়ে কর্মসংস্থান পেয়ে যায়। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেভাবে ছিল, সেটাই ফলপ্রসূ ছিল বলে আমি মনে করি। নতুনভাবে এটাকে সাজানো হলে এ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কারণ, শিক্ষা ও অর্থনীতি দুটোতেই এগুলোর প্রভাব রয়েছে।

পঞ্চগড়ের ময়দানদিঘী দ্বি মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র বলেন, অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের যেকোনো একটিতে যেতে হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, পরিবার বা শিক্ষকদের চাপের ফলে শিক্ষার্থীদের যেকোনো একটি বিষয় বেছে নিতে হচ্ছে।  ফলে, শিক্ষার্থীরা তাদের মনমতো বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে না। বিশেষ করে আমাদের মফস্বলে এমনটা হয়, যে কোনো শিক্ষার্থী জেএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করলে তাকে জোরপূর্বক বিজ্ঞান বিভাগে চাপিয়ে দেওয়া হয়।  এতে শিক্ষার্থী তার পছন্দমতো বিষয়ে পড়তে পারছে না। কিন্তু এসএসসির পর যখন বিভাজন হবে, তখন সব শিক্ষার্থী  স্বদিচ্ছায় নিজের বিভাগ সিলেক্ট করতে পারবেন, যা তাদের ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে। 

তিনি আরও বলেন, পিইসি পরীক্ষা না থাকলেও জেএসসি পরীক্ষা রাখা উচিৎ। কারণ, একজন শিক্ষার্থীর জন্য জেএসসি পরীক্ষা এসএসসির প্রস্তুতি হিসেবেও কাজ করে। কারণ, অনেকের মনে পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে একটা ভয়ভীতি কাজ করে কিন্তু এসএসসির আগে যদি একটা পাবলিক পরীক্ষায় উপস্থিত হতে পারে, তাহলে একটু হলেও তাদের ভয়ভীতিটা কমবে বলে আমি মনে করি।

কমলা বেগম, খগাখড়িবাড়ি ঝাড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, পিইসি-জেএসসির প্রয়োজন।  কারণ, যদি উঠে যায় এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাবে। যখন সার্টিফিকেটের বিষয় বা প্রাইমারি লেভেল থেকে হাইস্কুল লেভেলের মধ্যে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না, তখন গা ছাড়া একটা ভাব হয়ে যাবে। সমন্বিত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য ফলপ্রসূ হবে। প্রতিটা শিক্ষার্থী সব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবে, যা পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষাসহ ক্যারিয়ারের জন্য অনেক ভালো হবে।

এ বিষয়ে পঞ্চগড়ের ময়দানদিঘী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. এনামুল হক বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা না থাকলেও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মাধ্যমেই মূল্যায়ন করা উচিৎ। কারণ, আমাদের মফস্বলে যেসব পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে, সেগুলো এখনো তেমন উন্নতি করতে পারেনি। যেমন পরীক্ষা না হলে তার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের ‘বাড়ির কাজ’ দিয়ে মূল্যায়নের মাধ্যমে নতুন শ্রেণিতে তোলা হবে কিন্তু এক্ষেত্রে মফস্বলের অনেক স্কুলের শিক্ষকই এখনো এই বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি।  এছাড়া এ কাজে অভিভাবকদের যে সহায়তা প্রয়োজন, সেটিও শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন না। 

তবে তিনি পিইসি না রাখার বিষয়ে যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, পিইসি পরীক্ষা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর একটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে এবং তাদের মধ্যে ভয়ভীতি সঞ্চার করছে।  পিইসির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের চেয়ে বরং তাদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করছে।

সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা প্রভাব পড়তে পারে- এমন প্রশ্নে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক শরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।  ক্লাসে ফার্স্ট আর কেউ লাস্ট হলে এটা নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করে শিক্ষার্থীরা।  ক্লাস রোল যখন সরকার তুলে দিয়েছিল, এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। হয়তো নতুন সমন্বিত  শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে। লেটার মার্কস কিংবা এ প্লাস পাওয়ার চিন্তা থাকবে না। তবে, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্য যদি বাইরের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়, তাহলে তা আস্তে আস্তে তারা মেনে নেবে। এজন্য সরকারকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, শিক্ষামন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন (আগামী ২০২৩ সাল থেকে পিইসি, জেএসসি উঠে যাচ্ছে এবং নবম-দশম শ্রেণি থেকে সমন্বিত শিক্ষা চালু হচ্ছে) এটা আগামীর শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো দিক। তবে, প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কারিকুলাম অনুযায়ী প্রাথমিক  শিক্ষা এবং নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা রাখা উচিৎ। পরীক্ষা যত কম হয়, ততই ভালো। কিন্তু বিদ্যালয় কেন্দ্রিক যে বার্ষিক পরীক্ষা হয়, সেটা চালু রাখতে হবে। তাহলে শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য আছে, সেটা বাস্তবায়িত হবে। 

শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, নবম শ্রেণি থেকে যে বিভাগ কেন্দ্রিক বিভাজন উঠে যাচ্ছে, সেটা ইতিবাচক দিক। তবে, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে কেন থাকবে? এখান থেকেও উঠিয়ে দেওয়া উচিৎ। উন্নত বিশ্বে গ্র্যাজুয়েশনের আগে কোনো বিভাজন নেই।  ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি পড়া প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, এটা বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দিলে হবে না। একজন শিক্ষার্থী ম্যাচিউর হওয়ার আগে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা যে থাকছে না, এটা একটা ইতিবাচক সংবাদ। 

মাহি/সাইফ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়