ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বিষাদ বঞ্চনা আর বিদ্রোহের কবি বাহাদুর শাহ্ জাফর

সাঈদ আহসান খালিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিষাদ বঞ্চনা আর বিদ্রোহের কবি বাহাদুর শাহ্ জাফর

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

সাঈদ আহসান খালিদ
সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর বা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ (২৪ অক্টোবর, ১৭৭৫-৭ নভেম্বর, ১৮৬২) মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট। সোয়া তিন শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী দিল্লির মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ প্রতিনিধি, মরমী কবি ও সুফী সাধক সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের জীবন ইতিহাসে ট্র্যাজেডি হয়ে আছ। তাঁর রচিত কবিতা ও গজল এই ভাগ্যবিড়ম্বিত সম্রাটের নির্বাসিত জীবনের একাকীত্ব, বিষাদ আর অসহায়ত্বের অনবদ্য সাক্ষ্য বহন করছে। যে ক’জন প্রবাদপুরুষ অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেম ও চরম আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন, এই বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বপন করেছিলেন তন্মধ্যে সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের নাম বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য। তিনি সম্রাট বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের উত্তরসূরী শেষ মুঘল সম্রাট এবং মুঘল সাম্রাজ্যের মহাদুর্দিনে তিনি ভারতবর্ষের ক্ষমতা গ্রহণ করেন।


সম্রাট হলেও তিনি ছিলেন নামমাত্র। বাহাদুর শাহ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী ছিলেন। তিনি বার্ষিক ১ লাখ টাকা ভাতা পেতেন। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সম্পদ সব কিছু হারিয়ে সম্রাট প্রাসাদের চার দেয়ালের অভ্যন্তরে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। এ সময় অমর্যাদার মনোবেদনা ভুলে থাকার জন্য তিনি  গজল ও মুশায়েরায় নিমগ্ন থাকতেন; লালকেল্লায় সাহিত্যের আসর বসিয়ে সময় কাটাতেন। তিনি নিজেও কবিতা লিখতেন। জীবনের কষ্ট ও বিষাদ তাঁর কবিতার মূল বিষয়। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে দুঃখ ও বিষাদের পাশাপাশি দেশ ও জাতির পরাধীনতার বিষয় লক্ষ্য করা যায়। একটি কবিতায় আছে :

‘উমর এ দরাজ মাঙ কা লিয়ে চার দিন
দো আরজু মে কাট গেয়ি; দো ইন্তেজার মে’

অর্থাৎ ‘চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম। দু’দিন কাটল প্রত্যাশায় আর দু’দিন অপেক্ষায়।’


বাহাদুর শাহ্ সিংহাসনে আরোহণের ২০ বছর পর সূত্রপাত হয় ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের। পলাশী যুদ্ধের পর ১০০ বছর কেটে গেছে ততদিনে। ১১ মে সিপাহীরা দিল্লি অধিকার করে বহু ইংরেজ হত্যা ও বিতাড়িত করে। দেশপ্রেমিক সিপাহীরা এ দিন লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করে। সিপাহীরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেয়। এ দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশ বার তোপধ্বণির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে সম্মান জানানো হয়। বাহাদুর শাহ্ জাফর সিপাহীদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন-এ সংবাদে একের পর এক সেনা ছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। এক ঘণ্টার এ যুদ্ধে ৪১ জন দেশীয় সিপাহী নিহত হন। আর বন্দি হন বেশ কয়েকজন। রাজপুত্রদ্বয়ের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বৃদ্ধ, নির্যাতিত সম্রাটের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। পুত্রযুগল ও অন্যান্য প্রিয়জনের এমন করুণ ও নির্মম পরণতি প্রত্যক্ষ করে সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। বন্দি সিপাহীদের আন্টাঘরের ময়দানে (বর্তমান বাহাদুর শাহ্ পার্ক) সবার সামনে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়। দেশীয় প্রজারা যাতে ভয় পায় সে জন্য ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয়েছিল জনসমক্ষে। তবে সেদিন অকুতোভয় বীরসেনারা বীরদর্পে অম্লানবদনে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণপাত করেছিলেন। সিপাহী বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ্-এর স্মৃতিময় ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম পরিবর্তন করে এর নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ্ পার্ক। মুক্তিকামী মানুষের শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশের পুরনো ঢাকায় এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বাহাদুর শাহ্ পার্ক।


সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। রায়ে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়, এবং চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়। কিন্তু বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে  প্রাণ দণ্ডাদেশ না দিয়ে তাঁকে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) নির্বাসনে পাঠানো হয়।
ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের ছোট্ট গ্যারেজে সম্রাট ও তার পরিবারের বন্দিজীবন শুরু হয়। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয় একটা পাটের দড়ির খাটিয়ায়। প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহুদূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের শেষ দিনগুলো চরম হতাশা, দুঃখ ও নিগ্রহে কাটতে থাকে। ইংরেজ সরকার সম্রাট ও তার পরিবারের ১৬ জন সদস্যদের জন্য খোরাকি বাবদ দৈনিক ১১টাকা এবং প্রতি রবিবার ১২টাকা করে দিতেন। আর মাসের প্রথম দিন সাবান, তোয়ালে কেনার জন্য মাথাপিছু ২টাকা করে দিতেন। কাউকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হতো না। চাকর-বাকররা পাস নিয়ে তাদের কাছে যেতে পারত। সেই অমানবিক অবস্থায় এক বদ্ধ প্রকোষ্ঠে শতরকম শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের মধ্যে তিনি রচনা করেছিলেন অসংখ্য গজল, শায়েরির পঙ্ক্তিমালা। সম্রাটের ইচ্ছা ছিল ভারতের মাটিতে সমাহিত গওয়া। কেননা  জন্মভূমির প্রতি ছিল প্রচণ্ড অনুরাগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে। স্বদেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ কিংবা সমাহিত হওয়ার সাধ কোনোটাই পূরণ হবে না। এই নিদারুণ দুঃখে তিনি লিখেছেন একের পর এক কালোত্তীর্ণ কবিতা। সম্রাটের কবরের এপিটাফে খোদিত আছে সম্রাটের ভাগ্যবিড়ম্বিত অন্তরাত্মার করুণ চিত্র। সেখানে লেখা :

‘এতই হতভাগা জাফর, যে তার দাফনের প্রয়োজনে, দেশের দু’গজ মাটি তাও মিলল না’


সম্রাট অন্য এক কবিতায় খেদোক্তি করে নিজের জীবনের অসারতার কথা বর্ণনা করেছেন :

‘না কিসিকি আঁখকা নূর হুঁ,
না কিসিকি দিলকা কুয়ারার হুঁ
জো কিসিকে কাম না  আ সাকে,
মে ও এক মাস্ত-ই-ঘোবার হুঁ
মেরা রংরূপ বিঘাত গিয়া,
মেরা ইয়ার মুঝসে বিচ্ছাদ গিয়াৎ
যো ছামান ফিজা মে উজাদ গিয়া,
মে উসিকি ফ্যাসল বাহার হুঁ’


অভাব, অনটন, উপেক্ষা আর অবহেলায় সম্রাট পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। এমন বিড়ম্বনার্পূণ জীবনের অবসান হয় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর, শুক্রবার ভোর ৫টায়। সম্রাটকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রেঙ্গুন শহরের এক নির্জন এলাকায় অতি দীন-হীনভাব খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে সমাহিত করে ইংরেজ সরকার। কবরটি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল এক সময় নষ্ট হয়ে যাবে, ঘাসগুলো গোটা জায়গা আচ্ছাদিত করে ফেলবে। ফলে কোথায় সর্বশেষ মুঘল সম্রাট শায়িত আছেন তার চিহ্নও কেউ খুঁজে পাবে না। পরে তার আসল কবর আবিষ্কৃত ও সমাধিসৌধ নির্মিত হয়।



সন্দেহ নেই সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক নায়ক যার জীবন বিষাদ, বঞ্চনা, অবহেলা, আরে উপেক্ষার পদাবলীতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তবু তিনিই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, আমাদের চেতনার অঙ্কুরোদ্গম তাঁর হাত ধরেই হয়েছে। তাই আমাদের ইতিহাসের কাছে ফিরতে হবে-বিপ্লবের ব্যর্থতা কেবল  শোকগাথা নয়; নতুন প্রজন্মের কাছে উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদকে শনাক্ত করারও দিক নির্দেশনা।  আমরা চিনতে চাই হতভাগ্য সম্রাট বাহাদুর শাহকে, তাঁর সময়কালকে চিনতে চাই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকেও। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মিয়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধিসৌধ পরিদর্শন করেন। সে সময় তিনি পরিদর্শক বইতে লখিছিলেন :

‘দু’গজ জমনি তো না মিলি হিন্দুস্তানমে, পার তেরি কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকতমে, আজাদী কি পয়গাম সে।’

বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় : হিন্দুস্তানে তুমি দু’গজ মাটি পাওনি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই   আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চরিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ সেপ্টেম্বর ২০১৪/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়