ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৭ সিনেমা হল বন্ধ, জৌলুশ হারিয়েছে আরও একটি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১৭ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১২:৩৮, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৭ সিনেমা হল বন্ধ, জৌলুশ হারিয়েছে আরও একটি

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৮টি সিনেমা হলের মধ্যে একটি বাদে সবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। মালিকদের লোকসান আর বর্তমান প্রজন্মের মানুষজন ঘরে বসে ডিজিটাল মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ছবি-নাটক দেখতে পাওয়ায় সিনেমা হলের কদর কমে গেলে হলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। জেলায় রাজমহল নামে কেবল একটি সিনেমা হল টিকে রয়েছে, কিন্তু এটিও ধুঁকে ধুঁকে চলছে।

দেশি সিনেমা দর্শক টানতে ব্যর্থ হওয়ায় মালিকরা সিনেমা হল বন্ধ করে দিয়েছে বলে দাবি সংস্কৃতিকর্মীদের।

স্বাধীনতার পর থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত সিনেমা হলের আঙ্গিনা দর্শকদের পদচারণায় মুখরিত থাকত। ‘যে যত বেশি সিনেমা দেখেছে, সে তত বেশি চালাক-চতুর’ এমন কথাও তখনকার মানুষের মুখে শোনা যেত। এমনকি সেসময় দেশের অনেক জায়গার মোড় ও স্থানের নামকরণ করা হয়েছে সিনেমা হলের নামানুসারে।

সময়ের ব্যবধানে সেসব সিনেমা হলের জায়গায় এখন নির্মাণ করা হয়েছে শপিংমল, হলের ভবনগুলো কমিউনিটি সেন্টারকে দেয়া হয়েছে ভাড়া।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে ছিল ১৮টি সিনেমা হল। এরমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় ৪, শিবগঞ্জ উপজেলায় ৭, গোমস্তাপুর উপজেলায় ৩, নাচোল ও ভোলাহাট উপজেলায় দুটি করে ৪টি সিনেমা হল। এসব সিনেমা হলগুলোর মধ্যে ১৭টি বন্ধ হয়ে গেলেও কোনো মতে টিকে আছে মাত্র একটিই।

সর্বশেষ বন্ধ হয় শিবগঞ্জ উপজেলার ‘ডিজিটাল পদ্মা সিনেমা হল’। ১৯৭৩ সালে শিবগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদের উদ্যোগে শিবগঞ্জ বাজারে হলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মালিক ওজিউল মিঞা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই হলের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে।

১৯৮৬ সালে শিবগঞ্জ পৌরসভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ী ইদ্রিশ মোল্লা লাকি হল নামে একটি সিনেমা হল খোলেন। পরে মোড়টি ‘লাকি মোড়’ নামে পরিচিত পায়। দর্শক মুখরিত এই হলটি প্রায় ২২ বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বন্ধ হয়ে যায় শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর বাজারের ঝুমুর হল, দাদনচকের স্মৃতি সিনেমা হল, কানসাটের শাপলা, রানীহাটির স্মরণিকা, আড়গাড়াহাটের আশা সিনেমা হল।

গোমস্তাপুর উপজেলার বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় অভিলাষ, রহনপুর বাজারে রংধনু ও মুক্তাশা সিনেমা হল। এই সবগুলো হল-ই এখন বন্ধ। হলগুলোর ভবন মেরামত করে তৈরা করা হয়েছে মুদি ও ডেকোরেশনের দোকান ঘর।

নাচোল উপজেলায় একসময় মুখরিত ছিল আশা ও প্যারাডাইস সিনেমা হলের বারান্দা। সেসব স্মৃতি এখন শুধুই অতীত।

ভোলাহাট উপজেলার স্বপ্না এবং কিরণ সিনেমা হলের ভবন ভেঙে নির্মাণ করা হয় বহুতল বিল্ডিং। বিল্ডিংটি এখন মার্কেট হিসেবে পরিচিত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে ছিল গুলসান, সন্ধ্যা ও উদয়ন সিনেমা হল। গুলশান সিনেমা হল ভেঙে করা হয়েছে ক্লাব সুপার মার্কেট, সন্ধ্যা হল উঠিয়ে এখন ভবনটি ব্যবহৃত হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার এবং উদয়ন হল ভেঙে নির্মাণ হচ্ছে আধুনিক মার্কেট। তবে এই উপজেলায় কোনোমতে চলছে রাজমহল নামে সিনেমা হলটি।

সংস্কৃতি কর্মী ও সিনেমাপ্রেমীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিনেমা হলগুলোয় প্রদর্শিত হতো বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি সিনেমা। দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে দর্শক আসত সিনেমা দেখতে। হাতেহাতে স্মার্টফোন, ঘরে ঘরে ডিজিটাল ডিভাইস ও লোকসানের ভায়েই বন্ধ হয়ে গেছে সিনেমা হল। ঘরে বসেই দেশি-বিদেশি সিনেমা দেখা যাচ্ছে খুব সহজেই। শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের ইউটিউব ভিডিও চ্যানেলে সিনেমা দেখায় আগ্রহ। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে সব শ্রেণিপেশার মানুষ। তাদের দাবি, দেশীয় চলচ্চিত্রের মান ভালো না হওয়ায় সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শকরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংস্কৃতিকর্মী মাহবুব আলম জানান, একসময়ে সিনেমা হলগুলোয় দর্শকে মুখরিত থাকতো। কিন্তু এখন সিনেমা হলগুলোর বারান্দায় ঝুলছে দোকানের বিভিন্ন পণ্য, সেই সঙ্গে হলের বারান্দায় খদ্দেরের আনাগোনা। এদিকে সুস্থ বিনোদনের অভাবে সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি উঠতি বয়সি ছেলে-মেয়েরাও দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, একসময়ের সিনেমায় সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। সবাই একসঙ্গে বসে হলে সিনেমা দেখতো। কিন্তু এখন এসব ওঠে যাওয়ায় মানুষের মনে আন্তরিকতার অভাব দেখা দিয়েছে। দিনদিন মানুষের মন থেকে দয়া উঠে যাচ্ছে।

সিনেমার দর্শক নাহিদ আলম বলেন, নব্বই দশকের ছেলেরা সিনেমা দেখে অনেক কিছুই শিখতো। আগের সিনেমাগুলোয় সমাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের  শিক্ষা পাওয়া যেত। কিন্তু এখনকার সিনেমাগুলোয় এসব শিক্ষা পাওয়াতো দূরের কথা পারস্পারিক সৌহার্দ্যপূর্ণ আচারণের বার্তাও থাকে না।

শিবগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদের সহ-সভাপতি আলী আহম্মেদ বাবু বলেন, শিবগঞ্জের পদ্মা সিনেমা হলটি দীর্ঘদিন ধরে দর্শকশূন্য । লোকসান হওয়ায় হলটির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন হলের বারান্দা অস্থায়ী তরমুজের আড়ত এবং ভিতরে অংশে দোকানঘরের গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নতুন করে সিনেমা হল চালুর জন্য আমাদের কাছে কেউই আবেদন করেনি কিংবা ভাড়া চায়নি।

বর্তমান সময়ের মানুষ অনলাইনের সাহায্যে মোবাইলে দেশি-বিদেশি ছবি-নাটক দেখতে পাওয়ায় সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে- এ কথা মানতে নারাজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাংস্কৃতি কর্মকর্তা ড. ফারুকুর রহমান ফয়সল। তিনি বলেন, ইউটিউব বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোয় যে ভালো মানের ছবি নাটক তৈরি হচ্ছে; তা বলা যাবে না। সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মান্নোয়নে কাজ করলে ভালো মানের ছবি-নাটক পাওয়া সম্ভব। প্রযুক্তগত দিকে আমাদের থেকে ভারত, আমেরিকাসহ অনেক দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সেসব দেশগুলোতে থাকা সিনেমা হল বন্ধের খবর পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে।

সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে ছবি-নাটক নির্মাণে কার্যকারী তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়না। সেই সঙ্গে শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িতদের রক্ষণাবেক্ষণ করাও হয় না। দেশের গুণী শিল্পিদের নার্সিং করা গেলে, তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু  পাওয়া সম্ভব।

শিয়াম/ফিরোজ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়