ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মাশরুম চাষে রায়হানার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প 

মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৪, ২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:২৯, ২ ডিসেম্বর ২০২০
মাশরুম চাষে রায়হানার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প 

রায়হানা আক্তার। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা জেলার হাজারীবাগ থানার গজমহল নামক এলাকায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক করেন। বর্তমানে তিনি স্নাতকোত্তর করছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে।

করোনার সময়ে অনলাইনকে কাজে লাগিয়ে রায়হানা নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। নিজের উৎপাদিত মাশরুম নিয়ে ব্যবসা করছেন রায়হানা। তার ফেসবুক পেজের নাম ‘মাশরুম কথন’। রায়হানা তার উদ্যোক্তা জীবনের গল্প বলেন রাইজিংবিডিতে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার উদ্যোক্তা পাতার সহ-সম্পাদক মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া। 

রাইজিংবিডি: ব্যবসার শুরুর গল্পটা জানতে চাই।  

রায়হানা:  ব্যবসার পরিকল্পনা ছিল অনেক আগে থেকে। ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেই শুরু করি উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনা। এর জন্য প্রয়োজন ছিল ট্রেইনিং। একদিন বাবাকে নিয়ে চলে গেলাম ট্রেইনিং নিতে সাভারে। ট্রেইনিং নিয়ে শুরু করেছিলাম মাশরুম ব্যবসা।

কলেজ লাইফের পাশাপাশি স্বপ্ন দেখতাম উদ্যোক্তা জীবনের। কলেজ ও কোচিং শেষ করে চলে যেতাম বিভিন্ন জায়গায় পণ্যের মার্কেটিংয়ের জন্য। আমি বিজ্ঞান বিভাগের হলেও নিজের পণ্যের মার্কেটিং নিজেই করেছি। রাস্তায় রাস্তায়, দোকানে দোকানে, অলিগলিতে হেঁটে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম মাশরুমের গুণাগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে। একটা দুইটা অর্ডার আসা শুরু করলো। ট্রেইনিংয়ের পর সরকারিভাবে ৫০০ টাকা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে মাশরুমের বীজ কিনে চাষ করা শুরু করি। বিক্রির জন্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিতে থাকি। আমাদের দেশের মানুষ এই হালাল ও পুষ্টিকর খাবারটির মূল্য বুঝতো না। আবার ভুল-ভ্রান্তিতে জর্জরিত ছিল তাই এটির বাজারজাত করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার।

রাইজিংবিডি: কি কি পণ্য নিয়ে কাজ করছেন?

রায়হানা: আমি শুধু মাশরুম নিয়েই কাজ করছি। বর্তমানে ৪টি ভ্যারাইটি আছে, এগুলো হলো ওয়েস্টার মাশরুম, বাটন মাশরুম, মিল্কি হোয়াইট মাশরুম ও রিশি মাশরুম। ফ্রেশ মাশরুম, ড্রাই মাশরুম, পাউডার মাশরুমও করেছি। এরসঙ্গে ১টা ভ্যারাইটি ওয়েস্টার মাশরুমের ৩টি প্রজাতি উৎপাদন করছি।

শুধু মাশরুম নিয়েই নয়, মাশরুম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার নিয়েও কাজ করছি। আমি মাশরুম দিয়ে শামী কাবাব তৈরি করছি, যা উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স) গ্রুপে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এর স্বাদ, গন্ধ, গুণগত মান কোনো অংশেই মাংসের তৈরি শামী কাবাব থেকে কম নয়। 

এর পাশাপাশি আমি মাশরুম দিয়ে আচার তৈরি করছি। আচার আমাদের সবার পছন্দ। একটু বৃষ্টি পড়লেই যেন খিচুড়ি খাওয়ার ধুম পড়ে যায় আর সাথে চাই আচার। আর মাশরুম দিয়ে তৈরি আচারের মাশরুমের গুণাগুণ সর্বদা অটুট থাকে। সাধারণত ছোট-বড় সব বয়সের মানুষ আচার পছন্দ করেন, কিন্তু যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা পছন্দ করলেও খেতে পারেন না মিষ্টি জাতীয় আচার। কিন্তু এখন চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি তৈরি করছি সুক্রালোজ দিয়ে মাশরুমের ডায়াবেটিস আচার। আবার কোলেস্টেরল এর সমস্যা আছে ভয় পাচ্ছেন আচার খেতে, কোনো সমস্যা নেই, আমি তৈরি করছি ৮০ শতাংশ রসুন ব্যবহার করে মাশরুমের কোলেস্টেরল আচার।

রাইজিংবিডি: আপনি কি ভেবেছিলেন মাশরুম নিয়ে ব্যবসা করবেন?

রায়হানা: স্বপ্ন ছিল উদ্যোক্তা হবো। তাই নিজে ভাবতাম, অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করতাম কী ধরনের কাজ আছে, যার বাজারদর ভালো ও একজন মেয়ে হিসেবে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবো। একসময় পত্রিকা ও নিউজে জানতে পারলাম স্বল্প পুঁজিতে ঘরেই মাশরুম চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন মহিলারা। যখন আমি এটি নিয়ে রিসার্চ শুরু করলাম, তখন খবর পেলাম সাভারে একটি ট্রেইনিং সেন্টার আছে, যেখানে বিনামূল্যে সরকারি সার্টিফিকেটসহ ট্রেইনিং দেওয়া হচ্ছে মাশরুমের উপর। তখনি যোগাযোগ করলাম আর অপেক্ষায় ছিলাম সঠিক সময়ের।

আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেই আর দেরি না করে চলে গেলাম ট্রেইনিং নিতে। ট্রেইনিং নেওয়ার পর মনে হলো এই উপকারী খাদ্যটি নিয়ে কাজ করলে আমার দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে পারবো, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারবো।

রাইজিংবিডি: ব্যবসার শুরুটা কি অনলাইন কেন্দ্রিক, নাকি অন্য কোনো উপায়ে ছিল?

রায়হানা: শুরু বলতে যদি ২০০৯ এর কথা বলি, তাহলে সেটি ছিল পুরোপুরি অফলাইন ভিত্তিক। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে ও সঠিক গাইডলাইনের অভাবে সেইটি টিকিয়ে রাখতে পারিনি। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে আবার শুরু করেছিলাম নতুন পরিকল্পনা ও নতুন উদ্যমে, আর এই শুরুটা হয়েছিল শুধুই অনলাইন ভিত্তিক আমাদের প্রিয় ফেসবুক গ্রুপ নাসিমা আক্তার নিশা আপুর উইর হাত ধরে। এখানে সময় দিয়ে প্রথমে আমাদের শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যারের পরামর্শ ও গাইডলাইন অনুসরণ করে নিজের ভিত তৈরি করতে সময় নিয়েছি। যখন মনে হয়েছে এখন আমার কিছু শুরু করার সঠিক সময়, তখন আবার আমার পুরনো স্বপ্নটা পূরণ করার কাজে লেগে পড়েছি।

রাইজিংবিডি: কাজ করতে গিয়ে কি কি সমস্যা হয়েছে?   

রায়হানা: প্রথম দিকে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা বিব্রত মনে হতো। বয়স কম, বোঝার ক্ষমতাও ছিল কম। সাধারণ মানুষের চোখের সামনে সম্পূর্ণ নতুন একটি পণ্য নিয়ে গেলে মানুষ জড়ো হয়ে যেত, যেন চিড়িয়াখানা থেকে কোনো প্রাণি চলে এসেছে এমন দৃষ্টিভঙ্গি এগুলো থেকে কিছুটা বিব্রত হতাম। তবুও নিজের মনোবল শক্ত রেখে কাজ করে গেছি। কিন্তু বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বিব্রতকর অবস্থা এখনো পর্যন্ত হয়নি। আশা করি আর হবেও না।

রাইজিংবিডি: নতুন উদ্যোক্তারা এই পেশায় আসতে চাইলে, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

রায়হানা: খুব চমৎকার প্রশ্ন করেছেন। আমি চাই এই সেক্টরে উদ্যোক্তা তৈরি হোক। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা। কারণ, এটি সহজেই নিজের বাড়ির বা ঘরের যেকোনো জায়গায় অল্প পরিসরে স্বল্প পুঁজিতে শুরু করা সম্ভব। অন্তত নিজেদের খাদ্য যোগান দেওয়া সম্ভব। মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে, যা মাছ-মাংসের বিকল্প হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। আমি মনে করি, ছোটখাটো একটা ট্রেইনিং নিয়ে যেকেউ রেডিমেড বীজ (স্পন) সংগ্রহ করে শুরু করে দিন। এখন শীতকাল, মাশরুম চাষের উপযুক্ত সময়।

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা জীবনে সফল হতে কাদের ভূমিকা বেশি ছিল?

রায়হানা: সবার প্রথমেই আমার বাবা-মা। তাদের বিশ্বাস ছিল আমি ভালো কিছু করতে পারবো ও সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন সাহায্য করার। পরিবারের সদস্যরা ও আমার বান্ধবীরাও সাহায্য করেছেন। কিন্তু একজন উদ্যোক্তা হতে হলে কি কি করণীয়, কীভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে, কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে, কি কি জ্ঞান থাকা আবশ্যক, একজন উদ্যোক্তার মধ্যে এই শিক্ষাটি দিয়েছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যার। স্যারের পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা ছিল আমার জন্য আশীর্বাদ। 

আমার জীবনে সত্যিকারের উদ্যোক্তা ও সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাজিব আহমেদ স্যার। উই গ্রুপে এসে কাকলি রাসেল তালুকদার, নিগার ফাতেমা আপুদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাদের সফলতা দেখে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছি ও সফলতার সঙ্গে এগিয়ে গেছি।

রাইজিংবিডি: ব্যবসা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

রায়হানা: বর্তমান প্রেক্ষাপটের কথা যদি বলি, আমার ব্যবসাটি শুরু করেছি যখন পুরো পৃথিবী করোনার প্রকোপে থমকে গিয়েছিল। কিন্তু আমার ব্যবসাটি ভালো হয়েছে। আর এটি হয়েছে শুধু উইর মতো প্ল্যাটফর্ম পেয়েছিলাম বলে। সবাই ঘরে বন্দি ছিলাম, কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ অনলাইন কেন্দ্রিক হতে শিখে গেছেন, তাই এখন বেশির ভাগ মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। আমি বিশ্বাস করি ই-কমার্সের মাধ্যমে আমি ভবিষ্যতে খুব ভালো কিছু করতে পারবো।

আমার প্রথম পরিকল্পনা হলো আমার দেশের মানুষকে মাশরুম চেনানো, মাশরুম সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানানো ও বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে মাশরুমের তৈরি খাবার নিশ্চিত করা। তারপর বিভিন্ন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতির দিকে ভূমিকা রাখা।

রাইজিংবিডি: আপনার উদ্যোগ ‘মাশরুম কথন’-এর সফলতার কথা জানতে চাই।

রায়হানা: আমার শুধু উদ্যোগ নয় ‘মাশরুম কথন’ আমার স্বপ্ন। এটি শুধু একটি পেজ নয়, আমার স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম। আমি এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে চাই। প্রথমে শুধু একটা পেজ তৈরি করে রিসেলার হিসেবে কাজ করি। ডিএসবি (ডিজিটাল স্কিল ফর বাংলাদেশ) গ্রুপ থেকে ব্যবসা নিয়ে জানার ভিত শক্ত করে গড়ে তুলেছি। পেজ ম্যানেজমেন্ট, ডোমেইন, হোস্টিং, কন্টেন্ট রাইটিং, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি, ভিডিও মেকিং, এক্সেলশিট ক্রিয়েট ও ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, এসইও, ওয়েবসাইট ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার ফলে সেভাবেই নিজের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে গেছি। ফলে আজকে আমার ‘মাশরুম কথন’ সফলতার মুখ দেখতে পেরেছে। 

আমি যদিও আমার উদ্যোগটি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম ২০০৯ থেকে কিন্তু তখন আমি উই গ্রুপ পাইনি। পাইনি ডিএসবির মতো শিক্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম। তাই তখন সফল হতে পারিনি। উই’র মাধ্যমে নিজের স্বপ্নকে আবার জাগিয়ে তুললাম। আর শুরু করলাম মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে। 

রাইজিংবিডি: আয় কেমন? 

রায়হানা: আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়েছে মার্চ ২০২০ থেকে। আমি কাস্টমারকে যা প্রতিশ্রুতি দেই, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছি। এই দীর্ঘ নয় মাসের ব্যবধানে আমার এক লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়েছে। সম্প্রতি উই’র তৃতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল অনলাইন সামিট। আমি এই সামিটে স্পন্সর হিসেবে সম্মাননা হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যারের নিকট থেকে। এটি ছিল আমার জন্য খুবই আনন্দঘন মুহূর্ত।

রাইজিংবিডি: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

রায়হানা: আমার ব্যবসা নিয়ে বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় রাইজিংবিডিকে।  

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়