ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

পাঠকমনে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়া একটি গল্পগ্রন্থ

অভিনব বসু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  
পাঠকমনে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়া একটি গল্পগ্রন্থ

অনুপ্রাণন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর’ লেখক মঞ্জু সরকারের কয়েকটি ছোট গল্পের সঙ্কলন। ‘ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর’ শীর্ষক গল্পটি ছাড়াও রয়েছে আরও সাতটি গল্প। প্রতিটি গল্পই সুপাঠ্য, ভাষা সহজ ও গঠন আকর্ষণীয়। 

পুস্তকের প্রথম তিনটি গল্প অতিমারি পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে। ২০২০-২১ আমরা যেন এক অদ্ভুত জীবন যাপন করছি। বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী এক মাইক্রোস্কপিক ভাইরাসের হাতে তুমুল নাকানি-চুবানি খেয়েছে, কোথাও এখনও খেয়ে চলেছে। লকডাউন, প্যান্ডেমিক, পরিযায়ী শ্রমিক- এ সবই আমাদের কাছে সব নতুন নতুন শব্দ। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। বেশ কিছু গদ্য, উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই তা নিজস্ব পরিকাঠামো, পরিবেশের বাইরে বেরোতে সক্ষম হয়নি। এখানেই মঞ্জু সরকারের গল্পগুলি আলাদা। প্রথম গল্প ‘সংক্রমণ' করোনাকালে এক মধ্যবিত্ত বয়স্ক দম্পতির অসহায়ত্ব তুলে ধরেছে। এক বাড়িতে আলাদা থাকা, নিজেদের সংক্রমণ নিয়ে দোলাচলের মাঝে প্রতিবেশী, কাজের মেয়ে সব জায়গা থেকেই আসতে থাকা নেতিবাচক খবর স্বামী-স্ত্রীর মাঝের দূরত্ব কখনো বাড়িয়ে দেয় আবার কখনও তাদের কাছে টেনে নিয়ে আসে।    

‘জেলে একা ডা. আফ্রিনা আক্তার’ গল্পটি নখ-দন্তযুক্ত হিংস্র মানুষদের। অতিমারির সুযোগ নিয়ে কীভাবে ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন্দ্র, কীভাবে ব্যাক চ্যানেল দিয়ে চলে আসছে লাইসেন্স, আর জলের দরে বিকোচ্ছে কোভিড টেস্ট রেজাল্ট, সার্টিফিকেট! লোভ, লালসা, উচ্চাকাঙ্খা কখন মানুষকে অতলে তলিয়ে নিয়ে যায় তা কোনো দিব্যদৃষ্টিতেই দেখা যায় না। মানুষ সম্পর্ক ব্যবহার করে সিঁড়ি বানায় কিন্তু যখন পিছলায় তখন সে হয়ত একা, সম্পর্কহীনদের সাথে রাত্রিবাসে। 

‘মুখোশের আড়ালে’ গল্পটি আমাদের শহরের সেই শ্রেণীদের উপর যাদের আমরা দেখতে পাই না। মধ্য-নিম্নবিত্তের সঙ্গী রিকশাওয়ালা। আমাদের কত ঝগড়া, ভালোবাসার সাক্ষী সে রিকশাওয়ালা। লকডাউনে যখন মধ্যবিত্তেরা ছুটি কাটাচ্ছে তখন এদেরও কাজের ছুটি। মানুষ ঘরের বাইরে না গেলে রিকশায় কে উঠবে? কমর রিকশাওয়ালা বুঝে উঠতে পারে না সে শহরে থাকবে না গ্রামে ফিরে যাবে। অনেক চেষ্টা করে প্রায় পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরেও সে সম্মুখীন হয় একাধিক প্রশ্নের। দস্যু রত্নাকরের মতো সব পাপের বোঝা যেন তাকে একাই বইতে হবে। কোয়ারান্টাইন তার কাছে যেন সেই বোঝার মতোই।  

সংগ্রহটিতে বাকি যে গল্পগুলি আছে সেগুলিও যেন আমাদের সমাজের নানান অসুখকে প্রত্যক্ষ করায়। হয়ত অতিমারি নয়, নয় কোনো শারীরিক অসুখ কিন্তু কিছু অসুখ রয়ে গেছে আমাদের মনের অনেক গভীরে। বহু বছর, বহু প্রজন্ম ধরে আমরা তাকে লালন করেছি। কখনও এ অসুখ সংস্কারের, কখনও লোকলজ্জার, কখনও রাজনৈতিক ভেদাভেদ বা যৌন হিংসার। ‘মৃত্যুঞ্জয়ী লম্ফ’ গল্পটি আদতে ভালোবাসার গল্প, একাকীত্বের গল্প। এক বিপত্নীক বৃদ্ধের সঙ্গী খোঁজার গল্প। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে বৃদ্ধ স্বামী কি শুধুই অপেক্ষা করবে যে কবে তাঁর ডাক আসবে? তাই তাঁকে ধর্মে মন দিতে হবে, স্বর্গের পথ সুগম করতে হবে? এই যদি সংসারের নিয়ম হয় তাহলে সে নিয়ম কতটা সঠিক? কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো নিয়মে বাঁধা কতটা যুক্তিযুক্ত? প্রশ্নগুলি আমাদের সামনে তুলে ধরে গল্পটি।

‘টোপ' গল্পটি যেন একটি আয়না। গল্পের শুরু মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রাক্কালে। রাজাকার সন্দেহে বিহারী এক অনাথ কিশোরকে মারতে উদ্যত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। বাপ-মা মরা ছেলেটি এক গ্রাম্য বাঙালি পরিবারের আশ্রয়ে রয়েছে। যদিও গল্পের নায়কের একটি সিদ্ধান্তে তার জীবন বেঁচে যায়। তাকে টোপ হিসাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়। ঠিক হয় যদি সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় তাহলে আশ্রয়দাতার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে, জ্বালিয়ে দেওয়া হবে তাদের ঘর বাড়ি। এর ফলে তার আর সে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া হয় না। ‘টোপ বসির’ নামে সে রয়ে যায় গ্রামে। বাঙালিদের সাথে থেকে সে বাঙালিই হয়ে যায়। বহুদিন পরে আবার যখন তার সাথে কথকের দেখা হয় তখন দুজনেই বৃদ্ধ। বসিরের গান কথককে এক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। তাকে প্রাণে বাঁচতে বাঙালি হতে হয়েছিল, আর আজ পেট ভরাতে হতে হচ্ছে দলদাস?

‘একটি হ্যান্ডশেক ও হাজার দীর্ঘশ্বাস’ গল্পটি জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এক স্বপ্নালু মুক্তিযোদ্ধার। বঙ্গবন্ধুর চেতনার প্রভাব বঙ্গজীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আজ কি শুধুই প্রত্যক্ষ সম্পর্কেরাই বেঁচে আছেন? যাঁরা বঙ্গবন্ধুর চেতনা এখনও নিজেদের মধ্যে জিইয়ে রেখেছেন, তাঁর দেখানো পথে জীবন যাপন করে চলেছেন তাঁদের কথা শোনার কি আজ আর কেউ নেই? 

‘উৎসমূলের আগুন’ একটি জটিল মনস্তাত্বিক গল্প। প্রাক্তন প্রেমিকার মেয়ের দ্বারা সোশ্যাল মিডিয়ায় যৌন হয়রানির অভিযোগের সম্মুখীন প্রাক্তন সচিব উমর আলী। মুহূর্তের মধ্যেই সংসার, সমাজ সকলের কাঠগড়ায় তিনি। সত্য, মিথ্যা, কল্পনা, মনোবিজ্ঞানের ঘেরাটোপের মধ্যে আমাদের নিয়ে চলেন লেখক। মুহুর্মুহু দোলাচলে পাঠকের সামনে লেখকের প্রশ্ন, জীবনে যা ঘটে তা সবটাই কি সাদা- কালো? 

সর্বশেষ গল্পটির নামেই গ্রন্থের নামকরণ, ‘ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর’। গরীব গ্রামের পাঁকে পদ্মফুল এক সুন্দরী নারী ও তার সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে এই গল্প। শুধুমাত্র সুন্দরী হওয়ার কারণেই গ্রামের পুরুষদের চক্ষুশূল তারা বা হয়ত সুন্দরী কিন্তু অপ্রাপ্য, সেটাই মূল কারণ। ভূমিহীন এই পরিবার গ্রামের সরকার সাহেবের দেওয়া জমিতে থাকত। শহুরে ছেলেরে সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে সকলে ঢাকায় যায়। সেখানে জামাই তাদের জন্য গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ ঠিক করে রেখেছে। এরপরে একদিন হঠাৎ স্বামী, স্ত্রী, মেয়ে, জামাই সবাই উধাও হয়ে যায়। তাদের ফোন বন্ধ, সকল প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গ্রামের সকলে মিলে শুরু করে নিখোঁজদের সন্ধান। 

সংকলিত গল্পগুলি সবকটিই সমকালীন, এমনকি যে গল্পগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের পট আছে সেগুলিও এসে মিশছে বর্তমানে। গল্পে বারে বারে ফিরে এসেছে মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট। হয়ত বয়স্ক মানুষদের হাতে এর অপটু প্রয়োগ হচ্ছে কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের সাথে যোগাযোগের জন্য সব ক্ষেত্রেই এ ছাড়া গতি নেই। লেখকের শব্দ চয়ন অনবদ্য ও সাবলীল। সংলাপের ক্ষেত্রে স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভাষা ও শব্দের পরিবর্তন মন কাড়ে। বিষয়বস্তু জটিল হলেও সাবলীল ভঙ্গীতে লেখা এই গ্রন্থ পাঠকদের মনে অবশ্যই স্থায়ী জায়গা করে নেবে।

‘ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর’ প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। 

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়