ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

জামাই ছাড়ব তবু তামাই ছাড়ব না

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৩১ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জামাই ছাড়ব তবু তামাই ছাড়ব না

লুঙ্গি বোনার কাজ চলছে (ছবি : সংগৃহীত)

শাহেদ হোসেন : গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করতেই রাইজিংবিডির সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আদিত্য রাসেল বললেন, ‘ভাই, এই গ্রামের একটি ঐতিহ্য আছে।’ একটু নীরবতার পর একগাল হেসে রাসেল বললেন, ‘এখানকার মেয়েরা বিয়ের পরও গ্রাম ছাড়তে রাজী নয়। তাদের দাবি হচ্ছে, জামাই ছাড়ব তবু তামাই ছাড়ব না।’

এর মধ্যেই আমরা তামাই বাজারে পৌঁছে গেছি। মোটরসাইকেল থেকে নামতে নামতে রাসেলের কাছে জানতে চাইলাম, এই গ্রামের মেয়েদের এই দাবির কারণ কী। রাসেলের জবাব হচ্ছে, লুঙ্গির গ্রাম বলে খ্যাত বেলকুচির এই গ্রামের প্রায় প্রত্যেক নারী লুঙ্গি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। সংসারের কাজের ফাঁকেই এই কাজ করে তাদের মাসে বেশ ভালো আয় হয়। এই কারণেই তারা সহজে তামাই ছাড়তে রাজী হয় না।

সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার ভাংগাবাড়ি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তামাই। প্রায় পাঁচ বর্গকিলোমিটারের এই গ্রামের জনসংখ্যা ২০ হাজারের উপরে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে তাঁত। বাসিন্দাদের দাবি, বাংলাদেশে উৎপাদিত লুঙ্গির ৬০ শতাংশই এই গ্রামে তৈরি হয়। তবে সরকারি বা বেসরকারিভাবে এ ব্যাপারে তেমন কোনো পরিসংখ্যান নেই। পাকিজা, আমানত শাহ, স্ট্যান্ডার্ড, এটিএম, অনুসন্ধান, সম্রাট, মেমোরি, ফজর আলী, হিমালয়, বোখারী নামের ব্র্যান্ডসহ বাংলাদেশের নামী লুঙ্গির ব্র্যান্ডগুলো প্রায় সবাই তামাই থেকে লুঙ্গি কিনে থাকে। পরে নিজস্ব লেবেল লাগিয়ে তারা সেগুলো বাজারজাত করে।

 

নালীতে প্যাঁচানো সুতা (ছবি : শাহেদ)


তামাই হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যাক্ষ আব্দুল্লাহ শেখের ভাষ্য অনুযায়ী, এই গ্রামে পাওয়ারলুম আছে ১০ হাজারেরও বেশি। এককালে এখানে হস্তচালিত তাঁতের জয়কার থাকলেও দাম ও চাহিদার বিবেচনায় তা লুপ্তপ্রায়। লুঙ্গির সুতা প্যাঁচানো থেকে শুরু করে একেবারে বিপণন পর্যন্ত গ্রামের প্রায় সবাই কমবেশি জড়িত। আর এদের মধ্যে নারী রয়েছেন চার থেকে পাঁচ হাজার। অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবে আছেন সাড়ে চারশ পাওয়ারলুম মালিক।

তামাই বাজারেই হাজি আব্দুল হামিদ প্রামাণিকের বাড়ি । এলাকায় তিনিই প্রথম পাওয়ারলুম এনেছিলেন বলে সবাই তাকে পাওয়ারলুম হামিদ বলেই ডাকতেন। হাজি আব্দুল হামিদ মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। এখন তার ব্যবসা দেখভাল করছেন তিন ছেলে। বাড়িতে গিয়ে পাওয়া গেলো কনিষ্ঠ সন্তান আতিকুল ইসলামকে। তিনি জানালেন, ১৯৪৮ সালে তার বাবা চারটি খটখটি (হস্তচালিত তাঁত) দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে নরসিংদীর মাধবদী থেকে তিনি আটটি পাওয়ারলুম এনেছিলেন তামাই গ্রামে। এরপর ১৯৯৬ সালে কয়েকটি ভারতীয় পাওয়ারলুম নিয়ে আসেন । দুই বছরের মাথায় এগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়। এখন তাদের ৩৬টি চীনা পাওয়ার লুম রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তারা উৎপাদন করেন এক হাজার থান লুঙ্গি। এক থানে থাকে চারটি লুঙ্গি। আর সপ্তাহে তাদের বিক্রি হয় ছয়শ থেকে সাতশ থান।

এখানকার মেয়েরা জামাই ছাড়তে রাজী তামাই ছাড়তে রাজী নয়- স্থানীয়ভাবে প্রচলিত কথাটি সত্য কিনা জানতে চাইলে ফিক করে হেসে ফেলেন আতিক। ‘সত্যতাতো কিছুটা আছেই’ জানিয়ে এই তরুণ বলেন, ‘লুঙ্গি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নারীরা মূলতঃ নলীতে সুতা পেঁচানোর কাজ করে থাকেন। ঠিকঠাকমতো কাজ করলে একজন নারী অনায়াসে প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। তাই বিয়ের পরও এখানকার মেয়েরা সচরাচর গ্রাম ছেড়ে যেতে রাজী হন না।’

 

চলছে সুতা রং করার কাজ (ছবি : শাহেদ)


তামাইয়ে একইসঙ্গে সুতা ও লুঙ্গির ব্যবসা করছেন আহমেদ এন্টারপ্রাইজ ও টু ব্রাদার্স উইভিং ফ্যাক্টরির সত্ত্বাধিকারী আহমেদ সজল। সপ্তাহে সাত থেকে আট হাজার পাউন্ড সুতা বিক্রি করে তার প্রতিষ্ঠান। তার ২২টি তাঁত থেকে সপ্তাহে বাজারে পাঠানো হয় তিনশ থান লুঙ্গি। সাতশ থেকে চার হাজার টাকা দরে বিক্রি হয় এসব থান। লুঙ্গির বাজার ভালো নেই বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এই তরুণ। তার অভিযোগ লুঙ্গি বিপণনকারী বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে।

তিনি বলেন, ‘এইসব প্রতিষ্ঠান তাঁতীদের কোনঠাসা করে ফেলেছে। তাদের নির্ধারিত দামেই তাঁতীদের লুঙ্গি দিতে হয়। দাম বেশি চাইলেই তারা সাফ জবাব দিয়ে বসে আমাদের লুঙ্গির দরকার নাই, বাজার খারাপ। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আগাম টাকা নেওয়ায় তাঁতীদের হাত-পা একেবারে বাঁধা পড়ে যায়। একদিকে বাড়ে সুতার দাম, আরেক দিকে রঙের দাম। মজুরিও তো বছর গেলে বাড়ে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান লুঙ্গির দাম বাড়াতে চায় না।’

তামাই হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যাক্ষ আব্দুল্লাহ শেখ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘ভাই, আমাগো দেখার কেউ নাই। অনেক তাঁতী ঋণগ্রস্ত হয়ে পাওয়ালুম বিক্রি করে দিছে। তাঁতীগো অধিকার আদায়ে মিছিল-মিটিং করছি আমরা। কিন্তু কেউ আমাগো কথা শুনে না।’

তামাই থেকে ফেরার পথেই ঝুম বৃষ্টি শুরু । মোটর সাইকেল থামিয়ে দ্রুত আশ্রয় নিতে হলো একটি পাকা দালানের নিচে। টিনের ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ ছাপিয়ে সেখানে থেকেও ভেসে আসছিল পাওয়ারলুমের খটখট আওয়াজ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, আওয়াজ যতোই উপরে উঠুক না কেন, যুগ যুগ ধরে তাঁতীদের কান্না এই বৃষ্টির মতোই ঝরে পড়ে হারিয়ে গেছে বাংলার খাল-বিল নদীতে। শত বছরেও সেই অশ্রু মুছতে কেউই এগিয়ে আসেনি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মার্চ ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়