ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিউটি বোর্ডিং-এর ইতিহাস এবং তারক সাহার প্রয়াণ

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৫, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিউটি বোর্ডিং-এর ইতিহাস এবং তারক সাহার প্রয়াণ

জাহিদ সাদেক : পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংকে বাংলাসাহিত্য, কবিতা কিংবা সিনেমার আঁতুড়ঘর বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। বিউটি বোর্ডিং ছিল পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত ঠিকানা। মাঝে ভাটা পরে ১৯৭১ সালের মার্চে। পাকহানাদার বাহিনী জেনে যায় বাঙালির এই সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষদের মিলনমেলার কথা। ২৮ মার্চ এখানেই শহীদ হন বিউটি বোর্ডিংয়ের কর্ণধার প্রহ্লাদ সাহাসহ আরও ১৭ জন।

বর্তমান বিউটি বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থাপক বিজয় সাহা বলেন, ১৯৭২ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে দুই ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহাকে নিয়ে ফিরে আসেন প্রহ্লাদ সাহার সহধর্মিণী প্রতিভা সাহা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিউটি বোর্ডিংকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে পদক্ষেপ নেন কবি বেলাল চৌধুরী ও শহীদ কাদরী। এরপর একে একে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন অনেকে। শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রেরণায় আবারো নতুন উদ্যমে শুরু হয় বোর্ডিংয়ের কার্যক্রম। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তারক সাহা বিউটি বোর্ডিংয়ের হাল ধরেন। বড় ভাই সমর সাহাও খোঁজ নিতে ভুলতেন না। কেননা এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাদের পিতার ছায়া। কিন্তু একে একে নিভে যাচ্ছে জীবন প্রদীপ। গতকাল বুধবার তারক সাহা পরলোক গমন করেন।

পুরান ঢাকার ১ নম্বর শ্রীশ দাস লেন। সেখানেই কালের ভারে সঙ্গীন অবস্থায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির বহু অমর কীর্তির সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং। বাড়ির সামনে প্রশস্ত উঠোন। শ্যামল-সবুজে ঘেরা। বিউটি বোর্ডিংয়ের সাইনবোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকতেই স্বাগত জানাল এক টুকরো বাগান। ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। বাগান থেকে চোখ ফেরাতেই দেখা মিলল একটি পুরোনো বাড়ি- হলুদ রঙ, অনেকটা এল আকৃতির দোতলা। প্রখর রোদের মধ্যেও একটা শীতল ভাব— গাছপালা আর বাগানের জন্য। ডান পাশে অফিস। এর সামনে চোখে পড়ল একটি ডিজিটাল ব্যানার। শোকের কালো রঙের ওপর লেখা : ‘যে বন্ধুদের হারিয়েছি।’ সে তালিকায় তারক সাহাও যোগ হলেন গতকাল থেকে। তিনি রেখে গেছেন সহধর্মিণীসহ এক মেয়েকে।

কবি শামসুর রাহমান ও সৈয়দ শামসুল হক-এর সঙ্গে পরলোকগত তারক সাহা (ডান থেকে দ্বিতীয়)

 

বিউটি বোর্ডিং চল্লিশের দশক থেকেই সুখ্যাতি লাভ করেছিল। সমমনা লোকদের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছিল এই ভবন। কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘অতলের কথকথা’য় বন্ধু কায়েস আহমেদ সম্পর্কে লিখেছেন: ‘বন্ধু কায়েস আহমেদই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বিউটি বোর্ডিংয়ে জড়ো হওয়া কয়েকজন তরুণ সাহিত্যিকের সামনে। ...বিউটি বোর্ডিংয়ে সমবেত হতে পারার মাধ্যমে দেশের অনেক নবীন প্রবীণ সাহিত্যিকের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম।’ সৈয়দ শামসুল হক প্রসঙ্গে এক বক্তব্যে কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন: ‘বেশ মনে পড়ে বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং- এ তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয়।’ শামসুর রাহমান লিখেছেন: ‘মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলা বাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিং-এ পরস্পর মুখ দেখার আশায় আমরা কজন।’ এছাড়া কবি বেলাল চৌধুরী তাঁর ‘সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে’ বইয়ে বেশ কয়েক জায়গায় বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে লিখেছেন।

তারক সাহার বড় ভাই সমর সাহা জানালেন, বাড়িটি ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীরচন্দ্র দাসের। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে ওই দালানে গড়ে উঠেছিল ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার কার্যালয়, সঙ্গে ছিল ছাপাখানা। সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়। এ সূত্রেই ভবন মুখর হয়ে ওঠে শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকদের পদচারণায়। সোনার বাংলা পত্রিকাতেই ছাপা হয় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা। দেশ ভাগের সময় পত্রিকা কার্যালয়টি নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। ১৯৪৭-পরবর্তী দুই বছর খালি পড়েছিল ভবনটি। ১৯৪৯ সালে ভাড়া নেন মুন্সিগঞ্জের দুই ভাই নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদচন্দ্র সাহা। যাত্রাটা হলো খুবই সাদামাটা। ব্যবসা জমে উঠলে তৎকালীন জমিদার সুধীরচন্দ্র দাসের কাছ থেকে ১১ কাঠা জমি নিয়ে তাতে গড়ে তোলেন এই বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটির নামেই এর নামকরণ। সমর সাহা বলেন, ‘জায়গাটি ছিল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। সমমনা মানুষদের নির্জলা আড্ডা চলত দিনরাত। পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তুরের দশক ছিল বিউটি বোর্ডিং-এর যৌবনকাল। এ সময় আড্ডা দিতে আসতেন সে সময়ের প্রথিতযশা সাহিত্যিকরা।’

১৯৭১-এর শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ। উদ্বোধন করেন কবি শামসুর রাহমান

 

কবি শামসুর রাহমান থাকতেন আশেক লেনে এবং সৈয়দ শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজার। এই বিউটি বোর্ডিং-এ দুজনের পরিচয় হয়েছিল। বিউটি বোর্ডিং লাগোয়া একটি পুরনো দালানের দোতলায় থাকতেন কবি শহীদ কাদরী। বিকেলে বোর্ডিং-এর সবুজ চত্বরে এককাপ চা কয়েকজন ভাগ করে খেতে খেতে তখনকার শিল্পী সাহিত্যিকরা মেতে উঠতেন জমজমাট আড্ডায়। বোর্ডিং-এর একটি তালিকা থেকে দেখা যায়, এখানে আড্ডা দিতে আসতেন হাসান হাফিজুর রহমান, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, ফজলে লোহানী, কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, ভাস্কর নিতুন কুন্ডু, কবি আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রণেশ দাসগুপ্ত, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, সত্য সাহা, জহির রায়হান, খান আতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, খান আতাউর রহমান, প্রবীর মিত্র, নায়করাজ রাজ্জাক, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দিন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শফিক রেহমান, আসাদ চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ। ঐতিহাসিক বিউটি বোর্ডিং-এ থেকেছেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আড্ডা দিতে আসতেন গাজীউল হক, কমরেড আঃ মতিন, অলি আহাদ, সাইফুদ্দীন মানিক প্রমুখ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসীমউদদীন। এসেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখান থেকেই ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘কবি কণ্ঠ’। আহমদ ছফার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘স্বদেশ’সহ আরো বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী। কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখি করার জন্য একটা নির্দিষ্ট টেবিল এবং চেয়ার ছিল বিউটি বোর্ডিং-এ। এখানে বসেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক আব্দুল জব্বার খান। সমর দাস অনেক বিখ্যাত গানের কথায় সুর বসিয়েছেন এখানে আড্ডা দেয়ার ফাঁকে।

এরপর সময়ের বিবর্তনে বিউটি বোর্ডিং আগের মতো জমে ওঠেনি। সমর সাহা বলেন, ‘আমরা বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐহিত্য অম্লান রাখতে কম চেষ্টা করিনি। বিউটি বোর্ডিংয়ে এখন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের আড্ডা বা পদচারণা নেই। যদিও আমি কখনও চাইব না এই ঐতিহ্য নষ্ট হোক। জানি না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী করবে? আগের মতো আড্ডা কিংবা লেখকেরা আসেন না, কারণ পুরান ঢাকার যানজট। তাছাড়া লেখকেরা প্রায় সবাই নতুন ঢাকায় বসবাস করেন। যারা আশপাশে থাকেন তারা আসেন। জীবিতদের মধ্যে বিশেষ করে বুলবুল চৌধুরী নিয়মিত আসেন।

বিউটি বোর্ডিং নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানাতে গিয়ে সমর সাহা বলেন, ‘একাত্তরে আমার বাবাসহ যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি ম্যুরাল, একটি পাঠাগার এবং বিউটিয়ানদের একটি সংগ্রহশালা করতে চাই, যাতে তাদের কিছু স্মৃতি ধরে রাখতে পারি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।’

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়