ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৮ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম

মিরপুর দক্ষিণ পাইকপাড়া চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার হোম। ঠিকানাহীন দুস্থ এবং অসুস্থ মানুষদের ঠিকানা করে দিয়েছে এই শিশু ও বৃদ্ধাশ্রম। প্রতিষ্ঠানটি অন‌্যান‌্য বৃদ্ধাশ্রম থেকে বৈশিষ্ট‌্যে আলাদা। প্রথম দিকে ভাসমান অসহায় বৃদ্ধদের নিয়ে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। পরে শিশুদেরও যুক্ত করা হয়। বর্তমানে এখানে ৩৬ জন নারী ও ২৮ জন পুরুষসহ ৫ জন শিশু রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, পাইকপাড়ার ৪৬২ নম্বর বাসা এবং সংলগ্ন আরেকটি বাসা নিয়ে চলছে বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম। সেখানে কেউ ঘুমিয়ে আছেন, কেউ টিভি দেখছেন। তিন-চারজনকে দেখা গেল গল্প করতে।  তারা জানান, সকলেরই ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। যে কারণে শেষ জীবনে সহায়, ঠিকানাহীন হয়ে পড়েছিলেন। এখন কম-বেশি সবাই ভালো আছেন। এবং এই কৃতিত্ব মিল্টন সমাদ্দারের বলেও জানান তারা। তার কারণে এখন এখানেই তাদের সংসার।

প্রথম কক্ষে থাকা মাদারীপুর জেলার শিবচরের একজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানালেন, তিনি এখানে আছেন প্রায় ৩ বছর। শীতের কারণে অনেকটাই কাবু হয়ে পড়েছেন। পাশেই ছিলেন বৃদ্ধ সবুজ মিয়া। তিনিও শীতের প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, এখন শীতের কারণেই বেশি কষ্ট পাচ্ছি।

বৃদ্ধদের মধ্যে কয়েকজন মানসিক ভারসাম্যহীন রয়েছেন। অনেকেই আবার বয়সের ভারে এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, অন‌্যের সাহায‌্য ছাড়া কিছুই করতে পারেন না। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল মতিন জানান, তার বাড়ি খুলনা। তিনি রাজধানীর মিরপুরে থাকতেন। একসময় একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে একমাত্র ছেলে মারা যায়। তবে ছেলের বউ ও নাতি আছে। নাতি মিরপুর কমার্স কলেজে পড়ে। নাতি মাঝেমধ্যে এসে দেখে যায়। দুই মেয়ে খুলনায় বিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, মেয়েরা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আমি যাইনি। এখানে তিনি ভালো আছেন বলে জানান।

বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বরত কর্মচারী মিরাজ জানালেন, সপ্তাহে দুই দিন একজন চিকিৎসক আসেন। রয়েছে ওষুধ, আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার। এবার শীত বেশি হওয়ায় অসুস্থ নারী পুরুষকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। বৃদ্ধ হওয়ায় অনেকের একাধিক শীতের কাপড় প্রয়োজন। কিন্তু বাজেট সংকটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

এছাড়া ওষুধ কেনার জন্যও পর্যাপ্ত টাকা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত এই বৃদ্ধাশ্রমের ২৬ জন মারা গেছেন। তাদের কবর দিয়েছি মোহাম্মদপুর আর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।

নিজ উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তুলেছেন মিল্টন সমাদ্দার। পেশায় তিনি মেডিকেল অ‌্যাসিস্ট‌্যান্ট। তিনি বলেন, ‘আমার বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার ইচ্ছা ছিল না। বাসায় এক-দুজনকে রাখার ইচ্ছে ছিল। ঘরে ফিরে যাদের সঙ্গে গল্প করা যাবে- এই আরকি। তবে ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে উঠল আশ্রম।’

শুরুর গল্প জানতে চাইলে মিল্টন বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন। ছোটবেলায় কখনোই পেট পুরে ভাত খাওয়া হয়নি, কখনো নতুন কাপড় পরা হয়নি। একটু বড় হয়ে মানুষের বাসায় কাজ শুরু করলাম। সারা দিন কাজ করে পেতাম ২০ থেকে ৩০ টাকা। তখন থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা ছিল ভেতরে। ভাবতাম একজন মানুষকেও যদি তিনবেলা পেট ভরে খাবার দিতে পারি, তাতেও শান্তি।’

বৃদ্ধাশ্রম চালাতে অর্থকষ্টে পড়তে হয়। তবে বাইরে থেকে অনেকেই সাহায্য করেন জানিয়ে মিল্টন বলেন, ‘প্রতিমাসে সহযোগিতা করবেন নির্দিষ্ট এমন কেউ নেই। তবে কিছু শুভান্যুধায়ী রয়েছেন। কেউ নগদ টাকা, পোশাক, কেউ ওষুধ নিয়ে আসেন। আবার কেউ বিকাশে পাঁচশ-হাজার টাকা দেন। এ ধরনের সহযোগিতা দিয়েই চলছে এই সংসার।’

মিল্টন এখন চাচ্ছেন একটি জমি। তাহলে ভাড়া বাসায় থাকতে হবে না। নিজের মতো সাজিয়ে সেখানেই তিনি এই মানুষগুলোকে রাখতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘তখন আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাইব। হয়ত একজন মানুষ অনেককিছু দিতে পারবে না, কিন্তু একজন যদি এক বস্তা সিমেন্ট, দশটা ইট দিয়েও সাহায্য করেন তাও অনেক।’

বরিশালের উজিরপুরের সন্তান মিল্টন বলেন, আমার কোনো সঞ্চয় নেই। পাঁচ বছরের একটি ছেলে আছে। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া- বৃদ্ধাশ্রমের জন্য একটি স্থায়ী জায়গা। জীবনের শেষ দিনগুলো যাতে অসহায় মানুষদের জীবন একটু আনন্দ, ভালোবাসা, নিরাপদে কাটে এটুকু চেষ্টা আমাদের সবার করা উচিৎ।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়