ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ফিতরা কেন এবং কাদের জন্য

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১৪ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিতরা কেন এবং কাদের জন্য

শাহ মতিন টিপু : ফিতরা আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন। যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা খাদ্য গ্রহণ করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে ঈদে দানকে যাকাতুল ফিতর বা আহারের যাকাত বলা হয়। (উইকিপিডিয়া)

 

নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। দ্বিতীয় হিজরিতে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করার নির্দেশ দেন। একে সাধারণত রোজার ‘ফিতরা’ বলা হয়। এটা মূলত মাহে রমজানেরই নির্ধারিত সাদকা বা দান। শরিয়তের পরিভাষায় রমজান মাস শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন উপলক্ষে মাথাপিছু যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য গরিব-মিসকিনদের সাদকা করা হয়, একে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বলে।

 

রোজা পালনে বা সিয়াম সাধনায় অত্যন্ত সতর্কতা সত্ত্বেও যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, তার প্রতিকার ও প্রতিবিধান বা ক্ষতিপূরণের জন্য রমজান মাসের শেষে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। ধনীদের পাশাপাশি গরিবেরাও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে, সে জন্য ইসলামি শরিয়তে ঈদুল ফিতরে ধনীদের ওপর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ ওয়াজিব করা হয়েছে।

 

নবী করিম (সা.) সাদাকাতুল ফিতর এ জন্য নির্ধারিত করেছেন যাতে ভুলক্রমে সৃষ্ট গুনাহ থেকে রোজা পবিত্র হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘সাদাকাতুল ফিতর দ্বারা রোজা পালনের সকল দোষত্রুটি দূরীভূত হয়, গরিবের পানাহারের ব্যবস্থা হয়।’ (আবু দাউদ)

 

রমজান মাস শেষ দশক আসার সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারের অপরিহার্য কর্তব্য হলো নির্ধারিত পরিমাণে সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা। খেজুর, কিশমিশ, মুনাক্কা এবং যব দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হলে ১ সা অর্থাৎ তিন কেজি ৩০০ গ্রাম অথবা এর মূল্য আদায় করতে হবে। আটা বা গম দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হলে অর্ধ সা অর্থাৎ এক কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর সমান মূল্য আদায় করতে হবে। মাথাপিছু এক কেজি ৬৫০ গ্রাম গম বা আটা অথবা এর স্থানীয় বাজারমূল্যের সমান ফিতরা দিতে হয়।

 

মহানবী (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো, যেমন খেজুর, কিশমিশ, জব ও পনির। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমাদের সময় ঈদের দিন এক সা খাদ্য দ্বারা সাদকা আদায় করতাম। আর তখন আমাদের খাদ্য ছিল জব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (সহিহ বোখারি)

 

এরপর হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) যুগে গমের ফলন বেড়ে যাওয়ায় গমকে আলোচিত চারটি পণ্যের সঙ্গে সংযোজন করা হয়। আর তখন গমের দাম ছিল বাকি চারটি পণ্যের তুলনায় বেশি। আর মূলত এই দাম বেশি থাকার কারণেই হজরত মুয়াবিয়া গমকে ফিতরার পণ্যের তালিকভুক্ত করেছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলেন, নবীজি (সা.) এক সা খেজুর বা এক সা জব দিয়ে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। পরবর্তী সময় লোকজন (সাহাবা আজমাইনরা) দুই মুদ গমকে (আধা সা) এগুলোর সমতুল্য মনে করে এবং আদায় করে। (বোখারি)

 

ঈদের দিন সুবহে সাদেকের সময় যার কাছে যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থাৎ, অত্যাবশ্যকীয় আসবাব সামগ্রী ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, বাসগৃহ ইত্যাদি বাদ দিয়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সমমূল্য পরিমান সম্পদ থাকে তার উপর সাদকায়ে ফিতর দেয়া ওয়াজিব। উল্লেখ্য, যাকাতের মত এখানে এক বছর তার ঐ মাল অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়, বরং শুধু ঈদের দিনে মালিক থাকলে ফিতরা ওয়াজিব হবে। (ফাতওয়ায়ে তাতার খানিয়া)

 

এবারের ফিতরা : এবার জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৬০ টাকা ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৬৫০ টাকা ফিতরা নির্ধারণ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। গত ২৪ জুন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সভাকক্ষে জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটির এক সভা থেকে ফিতরার এ হার নির্ধারণ করা হয়। সভায় জানানো হয়, ইসলামী শরিয়াহ মতে, আটা, খেজুর, কিশমিশ, পনির ও যব ইত্যাদি পণ্যের যেকোনো একটি দিয়ে ফিতরা দেওয়া যায়। আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে এক কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ৬০ টাকা আদায় করতে হবে। খেজুর দ্বারা আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য এক হাজার ৬৫০ টাকা, কিশমিশ দ্বারা আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য এক হাজার ২০০ টাকা, পনির দ্বারা আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য এক হাজার ৬০০ টাকা এবং যব দ্বারা আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ২০০ টাকা ফিতরা আদায় করতে হবে। মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী উপর্যুক্ত পণ্যগুলোর যেকোনো একটি পণ্য বা তার বাজারমূল্য অনুযায়ী সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন।

 

সামর্থ্যবান পিতার ওপর তার নাবালক ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। সুতরাং নিজের ও নাবালক সন্তানাদির পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। মহিলাদের কেবল নিজের পক্ষে ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। নাবালক সন্তানের নিজের সম্পদ থাকলে তা থেকেই ফিতরা দেওয়া হবে। আর বালক সন্তানের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা মুস্তাহাব। ফিতরা সেসব গরিব-মিসকিনই পাবেন, যারা জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত।

 

সাদাকাতুল ফিতর ঈদের দু-তিন দিন আগে আদায় করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়। ফিতরা ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে আদায় করা সুন্নত। তবে ঈদের নামাজের আগে আদায় করতে না পারলে ঈদের নামাজের পর অবশ্যই আদায় করতে হবে। ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদাকায়ে ফিতরের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তা লোকেরা সালাতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগেই আদায় করে। নবী করিম (সা.) নিজেও ঈদের দু-এক দিন আগে ফিতরা আদায় করে দিতেন।’ (আবু দাউদ)

 

ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা দিয়ে দেওয়া উত্তম, নতুবা পরে আদায় করতে হবে। মহানবী (সা.) ঈদের দু-তিন দিন আগেই লোকদের একত্র করে ফিতরা বের করার নির্দেশ দিতেন। এতে করে গরিব-মিসকিনরা নিজ নিজ প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হবেন এবং ঈদের দিনে তাঁরাও পানাহারের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবেন। ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজাদার ব্যক্তির অসৎ কাজকর্ম থেকে সিয়ামকে পবিত্র করার জন্য এবং অভাবীদের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাদাকাতুল ফিতরের বিধান দিয়েছেন। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে এ ফিতরা আদায় করে দেবেন, তা জাকাত হিসেবে কবুল হবে আর নামাজের শেষে আদায় করা হলে তখন তা সাদকা হিসেবে কবুল হবে।’ (আবু দাউদ, ইবনে মাজা)

 

এ জন্য মাহে রমজানে সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা যথাসম্ভব রোজা শেষ হওয়ার আগেই দিয়ে দেওয়া উচিত। সাদাকাতুল ফিতরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঈদের খুশিতে গরিব শ্রেণির লোককেও শামিল করে নেওয়া। এতে একদিকে যেমন রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হবে, অন্যদিকে গরিব-দুঃখী মুসলমান নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া-পরার জিনিসপত্র সংগ্রহ করে অন্য মুসলমানের সঙ্গে ঈদের জামাতে শরিক হতে পারবেন। এতে  ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান কমে আসে এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি  গড়ে ওঠে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুলাই ২০১৫/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়