ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ঘটক এবং ঘটকালি

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০১, ১৬ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 ঘটক এবং ঘটকালি

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : পারিবারিক জীবন শুরু হয় নারী এবং পুরুষের একত্রে বসবাসের মধ্য দিয়ে। একজন নারী এবং পুরুষের একত্রে থাকার সামাজিক এবং আইনি বৈধতা পায় যে বিয়ের মাধ্যমে, সেই বিয়ে সংঘটন করা সহজ ব্যাপার নয়। সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান, জাত-বংশ, মর্যাদা, শারীরিক গঠন বা গায়ের রং মিলিয়ে বর-কনে মিল করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এই দুঃসাধ্য কাজটি সাধন করেন ঘটকরা।

 

বরপক্ষ ও কনেপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ করে বিবাহ সম্পাদনে মধ্যস্থতা করাই মূলত ঘটকের কাজ। ঘটকের আভিধানিক অর্থ ঘটনার সংঘটয়িতা। অতীতে ভারতীয়, বিশেষত বাঙালি সমাজে যুবক-যুবতীদের মেলামেশার সুযোগ তেমন ছিল না। পূর্বপরিচয় সূত্রে বর-কনের স্বেচ্ছায় বিয়ে করা সামাজিক বিধি-বিধানের পরিপন্থী গণ্য হতো। তাই ঘটকের মাধ্যমে বিবাহ স্থির হওয়ার রীতি ছিল বহুল প্রচলিত। এ জন্য সমাজে ঘটকের গুরুত্বও ছিল অনেক। কেউ কেউ ঘটকালি করে জীবিকা নির্বাহও করতেন। নির্ধারিত ফি ছাড়াও বিবাহকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর উভয়পক্ষ থেকে ঘটকদের পুরস্কৃত করা হতো।

 

তবে সময়ের সঙ্গে ঘটকালির প্রক্রিয়াও এসেছে বৈচিত্র্য। একটা সময় সমাজে নিজেদের পছন্দের বিয়ে প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। এখন অনেক ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের পছন্দ করার সুযোগ পান। এখন নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে। জীবনসঙ্গী পছন্দের ক্ষেত্রে নিজেদের মতামত জানানোরও সুযোগ পাচ্ছে।

 

সমাজে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেরা পছন্দ করে পরিবারের মতামত না নিয়ে বা পরিবারের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা যেভাবে গড়ে উঠেছে, সেখানে পরিবারের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের মতো বিয়ে করা কখনো সমর্থন পায় না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এলেও সমাজে ঘটকের গুরুত্ব কোনো অংশে কমে যায়নি।

 

ঘটকের কথা বললে এক সময় মনে ভেসে উঠত- পাঞ্জাবি পরা, মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি আর বগলে ছাতা নিয়ে হেঁটে চলা ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি। যে ব্যক্তিটির আশপাশের কয়েকটি গ্রামে বিশেষ জানাশোনা আছে। তবে সময়ের সঙ্গে ঘটকের পোশাক-আশাকে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি পাত্র-পাত্রী বাছাই বা দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। তবে ঘটকালি সংঘটনের প্রক্রিয়ায় যত পরিবর্তনই আসুক না কেন, সেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় এক ধরনের গোপনীয়তায়। বরপক্ষ ও কনেপক্ষের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়।

 

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘটকালি করান মান্নান সরকার। গাছ-গাছালি দিয়ে ওষুধ তৈরি করে কয়েকটি গ্রামের মানুষের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন তিনি। এ নিয়ে কয়েকটি গ্রামে তার পরিচিতি আছে। সেই পরিচয়ের সূত্রে ঘটকালিও করেন। ঘটকালি তার পেশা নয়। স্বেচ্ছাশ্রমে তিনি এটা করেন ভালো লাগা থেকে।

 

তিনি বলেন, ‘আশপাশের গ্রামের মানুষের সঙ্গে ওঠা-বসা হয়। গল্প-গুজবে কেউ যদি ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য বলে, তখন আমার পরিচিত পাত্র-পাত্রী থাকলে তাদের বলি। এতে মাঝে-মধ্যে বিয়ে হয়।’

 

আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা শিক্ষা-দীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে পাত্র-পাত্রী মিল করান? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সব বংশে তো আর সব প্রস্তাব দেওয়া যায় না। ছেলের বংশ, চাকরি, লেখাপড়া দেখে সেই রকম বংশের লেখাপড়া জানা মেয়ের কথা বলতে হয়।’

 

তিনি জানান, নির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও তিনি এখনো পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত বিয়ের মধ্যস্থতা করেছেন। ঘটকালির পর কেউ যদি খুশি হয়ে টাকা দেয়, তা নেন। কখনো চেয়ে নেন না। তবে বিয়ের পর দুই-পক্ষ থেকে পোশাক উপহার পেয়ে থাকেন।

 

একই উপজেলায় স্কুল শিক্ষক আয়ুব আলীও ঘটকালি করেন। তিনি বেশ কয়েকটি বিয়ের ঘটকালি করেছেন, তারা সবাই গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান। শিক্ষকতার পাশাপাশি ঘটকালি করেন বলে এলাকায় তার পরিচিতি আছে। এই সূত্রে অভিভাবকরা তার কাছে আসেন ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য। তিনিও বংশ, মর্যাদা, শিক্ষা-দীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে পাত্র-পাত্রী মিল করার চেষ্টা করেন।

 

নিজেকে ঘটক বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘ঘটক বলতে যা বোঝায়, আমি ঠিক তা না। বেশ কয়েকটি বিয়ে করিয়েছি, তাই চেনা-পরিচিত অনেকে আমার কাছে আসে ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য। আমার চেনা-জানা ছেলে-মেয়ে থাকলে তাদের বলি। এতে কখনো কখনো কাজ হয়।’

 

তবে তিনি জানান, তার মধ্যস্থতায় বিয়ে হলে তিনি দুই পক্ষের কাছে একটা ফি দাবি করেন। তবে অনেকে সেটা দেন না। বিষয়টি নিয়ে তিনি জোরাজুরিও করেন না।    

 

একটি বিষয়ে আলোচনা করে নেওয়া আবশ্যক যে, বিয়ের জন্য পা্ত্র-পাত্রী মিলমিশ করার জন্য এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মাধ্যম আত্মীয়-স্বজন বা চেনা-পরিচিত মানুষজন। এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর-কনে দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের সূত্রপাত স্বজন বা পরিচিতজনদের মাধ্যমে ঘটে। তবে ব্যস্ততাসহ বিভিন্ন কারণে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। এগুলো বিয়ের পাত্র-পাত্রী খোঁজার ক্ষেত্রে প্রভার ফেলছে। শহরের অলিতে-গলিতে গড়ে উঠেছে ম্যারেজ মিডিয়া সেন্টার। পত্রিকার পাতা ভরে থাকছে ‘পাত্র-পা্ত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন।

 

পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞাপন দেখে কয়েকটি ম্যারেজ মিডিয়া সেন্টারে যোগাযোগ করে জানা যায়, তাদের ওখানে পাত্র-পাত্রীর সন্ধানে গেলে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে সদস্য হতে হবে। এরপর তাদের কাছে রক্ষিত পাত্র-পাত্রীর বায়োডাটা দেখার সুযোগ পাবেন। যতদিন বিয়ে না হবে তারা এই সেবাটি দেবেন বলে জানান। যদিও এ সব ম্যারেজ মিডিয়া সেন্টারের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ফি জমা নিয়ে সেবা না দেওয়ার অভিযোগ আছে।

 

পত্রিকায় চোখ বোলালেই দেখতে পাবেন- ম্যারেজ মিডিয়া সেন্টার বা ঘটকের পাশাপাশি অনেক অভিভাবকও সন্তানের বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আবার বিয়ের পাত্র-পাত্রীর জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইটও চালু হয়েছে, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভিজিট করছেন। কেউ কেউ এভাবে জীবনসঙ্গী খুঁজেও পাচ্ছেন।

 

রাজধানীতে ঘটকালি ব্যবসার কথা বললে, যার নাম প্রথমে আসে তিনি ঘটক পাখি ভাই। ইস্টার্ন প্লাজায় অফিস নিয়ে প্রায় তিন দশক ধরে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ঘটকালি করে যাচ্ছেন তিনি। ঘটকালি ব্যবসায় তিনি আইকন বনে গেছেন। শুভ পরিণয় ঘটিয়েছেন বার সহস্রাধিক।

 

আমাদের সমাজে ‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা’ বলে একটি কথা আছে। যেটিতে মূলত- বিয়ের উপযুক্ত কন্যাকে বিয়ে দিতে না পেরে পিতার অসহায়ত্ব এবং দুশ্চিন্তার ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়েছে। এমনও বলা হয়- কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার রাতে ঘুম হয় না। এ বিষয়ের বাস্তবতা উপেক্ষা করা যাবে না। যাদের এ ধরনের ঘটনা গভীরভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে, তারা সহজেই এর বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন। সামাজিক মর্যাদা ও মান-সম্মান বিবেচনা করে সন্তানের বিয়ের বিষয়টি সব মহলেও পাড়তেও পারেন না অভিভাবকরা। আধুনিক ব্যস্ত ও যান্ত্রিক জীবনে মানুষে-মানুষে যোগাযোগ ও হৃদ্যতা কমেছে, এতে পাত্র-পাত্রীর মিল করানো আরো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমন অনেক নারীকে পাওয়া যাবে, অভিভাবক না থাকার কারণে বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে হয়নি।

 

ঘটকের ঘটকালি নিয়ে যত হাসি-ঠাট্টাই করি না কেন, পাত্র-পাত্রীর আর্থ-সামাজিক মর্যাদা, শারীরিক গঠন, গায়ের রং বা মতাদর্শ মিলিয়ে মিল-মিশ করার জটিল ও দুঃসাধ্য কাজটি তারা নীরবে করে যাচ্ছেন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ অক্টোবর ২০১৬/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়