মাগফিরাতের পূর্বশর্ত
মহান আল্লাহর রহমত ও দয়ার দিকে তাকিয়ে আমরা মাগফিরাতের আশা করতে পারি। তবে ক্ষমাপ্রাপ্তি এক তরফা হয় না। এটা দ্বিমাত্রিক। মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করে হাজারো নেয়ামতে পূর্ণ করে দিয়েছেন। তার পরিব্যাপ্তি এতো বেশি যে গণনা করে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। আল্লাহ তো অবশ্যই ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১৮)
তারপরেও আমরা তার আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা করি। তার নেয়ামতের শুকরিয়া করি না। আমাদের জীবন এমনভাবে যাপন করি যেনো তিনি নেই! তার উপস্থিতির কোনো ছাপই যেনো আমাদের দৈনান্দিন জীবনে থাকে না।
এতো কিছুর পরেও আমরা তার কাছেই ফিরে আসি। তার কাছেই সাহয্য চাই। তার কাছেই ক্ষমা চাই। এই রমজানেও আমরা তার কাছে ক্ষমা ও মাগফিরাত চাইছি। তবে আমরা মাগফিরাত পাবো কিনা তা নির্ভর করে আমাদের ওপরে। মাগফিরাত প্রাপ্তির জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। আছে কিছু পূর্বশর্ত।
আজকে আমরা মাগফিরাতের পূর্বশর্তসমূহ নিয়ে আলোচনা করবো।
মাগফিরাত মানে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তি। মানুষ জীবনে চলার পথে নানা সময়ে নানা রকম গুনাহ করে। সেসব পাপ থেকে ক্ষমা পাওয়ার নামই হলো মাগফিরাত প্রাপ্তি। ক্ষমা প্রাপ্তির প্রথম শর্ত হলো, সংঘঠিত পাপের ব্যাপারে অনুতপ্ত হওয়া। অনুতপ্ত হওয়ার মাত্রা যত গভীর হবে ক্ষমা প্রাপ্তির সম্ভবনা তত বৃদ্ধি পাবে। অনুতপ্ত হওয়া একান্ত অনুভূতির বিষয়। আল্লাহ তায়ালার দয়া, অনুগ্রহ, বড়ত্ব, শাস্তির বিষয় বিবেচনা করে এবং নিজের অপরাধের কথা মনে করে নিজের ভেতরে যে লজ্জা, অপরাধবোধ তৈরি হয় সেটাই অনুতপ্ত হওয়া। অনুতপ্ত ব্যক্তি বড়াই করে না, অহঙ্কার করে না। দাপট দেখায় না। তাকে দেখলেই মনে হবে লোকটা ব্যথিত, ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে চলছে। আমরা অতীতের যেসব অলি আল্লাহর কথা জানি তাদের সবারই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল এই ব্যথাতুর হৃদয়।
অনুতাপের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মানুষ হৃদয়ের গভীর থেকে কান্না করে দেয়, আল্লাহর কাছে হাত তুললে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে। নিজেকে খুবই তুচ্ছ মনে হয়, অপরাধী মনে হয়। অনেক সময় আল্লাহর কাছে হাত তুলতেও লজ্জা লাগে। তারপরেও আল্লাহর কাছে হাত তুলে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই দেখে লজ্জিত, ভাঙ্গা হৃদয়ে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন বলে আশা করা যায়।
ক্ষমা প্রাপ্তির দ্বিতীয় শর্ত হলো, অতীতের কৃত পাপের পুনরাবৃত্তি রোধ করা। যে অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছি সেই অপরাধ যদি বারংবার করি তাহলে এই ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হয় না। বরং এ ধরনের আচরণ বেয়াদবির পর্যায়ে পরে। সেজন্য ক্ষমা প্রাপ্তির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, যেসব অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছি তা যেনো কোনো ভাবেই পুনরায় আমার দ্বারা আর না হয়। ক্ষমা প্রাপ্তির এই স্তরটা কঠিন ও কষ্টসাধ্য।
আমরা আগের এক আলোচনায় বলেছিলাম যে, আমাদের পাপের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। পাপের ক্ষেত্র চিহ্নিত না করে গড়ে বা এজমালি মাপ চাওয়া এবং আবারো একই ধরনের পাপে লিপ্ত হলে ক্ষমা প্রাপ্তির সম্ভবনা কমে যায়। আমাদের সমাজে আমরা যে সব পাপ সাধারণত করি সেগুলো হলো- মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, মানুষের অধিকার নষ্ট করা, বেপর্দা হওয়া, সুদের সাথে সম্পৃক্ত থাকা, সুন্নাহ অসমর্থিত জীবন যাপন করা, নামাজ না পড়া, বছরের পর বছর জাকাত না দেয়া, জীবনের একটা দীর্ঘ সময় পর্ন্ত রোজা না রাখা, গিবত করা ইত্যাদি।
এসব গুনাহের মধ্যে অনেকগুলো ব্যক্তিগত। যেমন নামাজ না পড়া, মিথ্যা কথা বলা। এসব গুনাহের কাজ নিজে নিজে শক্ত প্রতিজ্ঞা করলে এবং নিজে নিজে চেষ্টা করলে ত্যাগ করা সম্ভব। আবার কোনো কোনো গুনাহের কাজ সামাজিকভাবে হয়। এগুলো থেকে ফিরে আসা কষ্টসাধ্য কাজ। যেমন সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা বর্তমান সমাজে খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। দাড়ি রাখা, পোষাকে সুন্নাহ অনুসরণ করা, বাসায় পর্দা নিশ্চিত করা, নিজের জীবনে পর্দা পরিপালন করার মতো বিষয়গুলো সহজে করা যায় না। সেজন্য পরিকল্পনা করা দরকার। এসব কাজে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে।
সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, সুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। আধুনিক অর্থনীতিতে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করেন তারা নানাভাবে সুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখান থেকে সরে আসা মুখের কথা না। খুবই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যাদের এতো দিনের আয়-রোজগার সুদের সঙ্গে জড়িত তারা দৃঢ় সংকল্প করে যে কোনো মূল্যে এখান থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করতে হবে। এবং বিদ্যমান জীবনাচার ও জীবনমান পুরো বদলে গেলেও সুদ থেকে সরে আসতে হবে।
আমরা যদি নিজেদের পাপের ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে সরে আসি, এবং সরে আসার পরিকল্পনা করি তাহলেই আমাদের ক্ষমাপ্রাপ্তির সম্ভবনা তৈরি হবে।
ক্ষমাপ্রাপ্তির এই স্তর অর্জন না করে আমরা যতই চোখের পানি ফেলি না কেন ক্ষমা প্রাপ্তি হবে না।
তারা//