শয়তানের মন্দির: বিস্ময়কর হলেও সত্য
আক্ষরিক নাম ‘স্যাটানিক টেম্পল’ বা ‘শয়তানের মন্দির’ বা ‘শয়তানের উপাসনালয়’। সবার কাছেই বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও বিষয়টি সত্যি। খোদ আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শয়তানের মন্দির। এ ছাড়া আফ্রিকায় খোলা হয়েছে আরেকটি শাখা। যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা বিভাগ এই মন্দিরকে ‘কর’ ছাড় দিয়েছে। ফলে ‘শয়তানের মন্দির’ পেয়েছে বৈধ ধর্মের স্বীকৃতি।
সিএনএন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাতা পেনি লেন নির্মিত ‘হেইল শয়তান’ নামক একটি তথ্যচিত্র এবং তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, স্যাটানিজম বা শয়তানবাদ মূলত মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাতকারী শয়তানের উপাসনা, ভক্তি ও প্রশংসা বোঝানো হয়ে থাকে। খুব বেশি দিন আগে নয়, গত শতকের সত্তরের দশকের শুরুতে শয়তানের উপাসক দলগুলোকে গুপ্ত ও অবৈধ মনে করা হতো। আধুনিক শয়তানবাদ প্রথম সবার নজরে আসে ১৯৬৬ সালে চার্চ অব স্যাটান বা শয়তানের গির্জা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৬৬ সালের ৩০ এপ্রিল এন্টন স্যান্ডর ল্যাভি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সানফ্রন্সিসকোতে নিজ বাড়িতে শয়তানের গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন।
ল্যাভি জীবিত থাকাকালীন তার বাড়িতে ‘ব্ল্যাক হাউজ’ নামে এক অনুষ্ঠানের প্রচলন করেন। সেখানে তারা কালো পোশাক পরে মিলিত হতেন। ১৯৯৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই মন্দিরের প্রধান ছিলেন। ল্যাভি মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। ১৯৬৯ সালে তার লিখিত ‘স্যাটানিক বাইবেল’ প্রকাশিত হয়। ল্যাভির মৃত্যুর পর চার বছর মহাযাজকের পদ খালি ছিল। ২০০১ সালে পিটার এইচ গিলমোর এ পদ লাভ করেন। চার্চ অব স্যাটানের সদর দপ্তর সানফ্রন্সিসকো থেকে সরিয়ে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন শহরের ‘হেলস কিচেনে’ আনা হয়। এটি মৃতদেহ অন্তেষ্টিক্রিয়ার আয়োজনকারী একটি বাড়িও বটে। ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সালেমের কেন্দ্রে শয়তানের মন্দিরের সদরদপ্তর অবস্থিত।
মন্দিরটিতে রয়েছে শয়তানের ধর্ম সম্পর্কিত একটি আর্ট গ্যালারি। আছে একটি লাইব্রেরি, যাতে রয়েছে শয়তানি সাহিত্য এবং ইতিহাস সম্পর্কিত বই। মন্দিরটির প্রধান আকর্ষণ একটি ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। এর মাথাটি অনেকটা ছাগলের মতো। পিঠে ঈগল পাখির মতো ডানা। নাম ‘ব্যাফোমেট’।
শয়তানের মন্দিরের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং মুখপাত্র লুসিয়ান গ্রিভস বলেন, ‘এটি আমাদের প্রাথমিক অনুষ্ঠানের কক্ষ। আমরা, শয়তানের মন্দিরের সদস্যরা সপ্তাহে একবার এখানে জড়ো হই।’ একটি প্রশ্নের জবাবে লুসিয়ান গ্রিভস বলেন, শয়তানের মন্দিরের সদস্যরা মূর্তিটি পবিত্র মনে করে না। ‘আধ্যাত্মিক’ বা ‘পবিত্র’ এই শব্দগুলো আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমরা কোনো অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস লালন করি না। আমরা মূলত একটি নিরীশ্বরবাদী ধর্ম। আমাদের কোনো ঈশ্বর নেই। আমরা কোনো কিছুর অতিপ্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিই না বা সেসব গ্রহণও করি না।
গ্রিভস আরো স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমরা পুরাণ ও সাহিত্যে যে শয়তানের কথা বলা হয় সেটাকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহী প্রতীক বা চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করি। আর এ কারণেই আমরা শয়তানের উপাসনা করি না বরং এই উপাসনার ধারণাটাই, যারা নিজেদের শয়তানবাদের সদস্যদের জন্য অপমানজনক একটা বিষয়। কারণ উপাসনা মানেই হচ্ছে অন্যের দাসত্ব। আর আমাদের শয়তানবাদের মূল কথা হলো ব্যক্তিগত সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং ইচ্ছার স্বাধীনতা।’
যদিও প্রতিষ্ঠাতা ল্যাভির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শয়তানবাদের বিশ্বাস নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আধুনিক শয়তানবাদী দলগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হলেও প্রধান দুটি ধারা হচ্ছে আস্তিক ও নাস্তিক। আস্তিক শয়তানবাদী দলগুলো শয়তানকে এমন একটি ইতিবাচক ধনুক হিসেবে বিবেচনা করে যারা গর্ব, ব্যক্তিবাদ এবং জ্ঞান উপস্থাপন করে। অন্যদিকে নাস্তিক শয়তানবাদীরা নিজেদের নাস্তিক মনে করে এবং শয়তানকে মনে করে মানুষদের কলুষিত চরিত্রের প্রতীক হিসেবে। ল্যাভির অনুসারীরা নাস্তিক ছিলেন। আর গিলমোর তার অনুসারীদের ‘সংশয়বাদী আস্তিক’ বলেছেন।
২০০৪ সালের অক্টোবরে রয়্যাল নৌবাহিনীর এইচএমএস কুম্বল্যান্ড জাহাজের প্রযুক্তিবিদ ২৪ বছর বয়সী ক্রিস ক্রানমার প্রথম শয়তানবাদে বিশ্বাসী হিসেবে স্বীকৃতি পান। ২০০৬ সালের ৬ জুন চার্চের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে লস এঞ্জেলেসের সেন্টার ফর ইনকুইয়ের স্টিভ অ্যালেন থিয়েটারে প্রকাশ্যে প্রথম স্যাটানিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ গোষ্ঠীর সদস্যরা এককালীন ২২৫ ডলার পরিশোধ করেন। তাদের সদস্যদের সংখ্যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না। শয়তানের গির্জার ধারণা থেকে পরবর্তীকালে ‘শয়তানের মন্দির’ নামে একটি নাস্তিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে লুসিয়ান গ্রেভ ও ম্যালকম জেরি এ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এর যুক্তরাষ্ট্রে ১৬টি, কানাডায় তিনটি এবং ব্রিটেন ও আফ্রিকায় একটি করে শাখা রয়েছে।
শয়তানের উপাসনাকারীরা কি মানব বলি দেয়? তারা কি রক্তপান করে? ব্ল্যাক ম্যাস বা কালো পোশাকে সমাবেশ করে? সেসবের উত্তর ওই তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে। শয়তানের পূজারিরা কালো পোশাক পরে সমাবেশ করলেও তারা মানব বলি বা রক্তপান করে না। এক সময় মনে করা হতো শয়তানের পূজারিরা এমন হিংস্র। তবে তারা নিজস্ব বিশ্বাস অনুসারে ধর্মচর্চার অধিকার চান। শয়তানের উপাসকরা অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, তারা কেউই শয়তানকে আধ্যাত্মিক কোনো সত্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন না। বরং হিব্রু ভাষায় স্যাটান বা শয়তান বলতে যে অর্থ বোঝানো হয় অর্থাৎ ‘বিরোধী’ বা ‘বিপক্ষের শক্তি’ হিসেবেই মনে করেন তারা।
স্যাটানিক ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন, ‘মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে যেসব বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় যেমন, ভালোবাসা, অধিকার, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা-এগুলো আসলে বস্তুগত কোন বিষয় নয় বরং এগুলো সবই ধারণা মাত্র।’ আর এগুলোর স্বাধীনতাই আমাদের ধর্মের মূল লক্ষ্য।
তারা//