ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইউক্রেন যুদ্ধ: ভাইকে বাঁচাতে জীবন দিলো ভাই

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১২, ২৯ মে ২০২৩   আপডেট: ১৩:১৫, ২৯ মে ২০২৩
ইউক্রেন যুদ্ধ: ভাইকে বাঁচাতে জীবন দিলো ভাই

আহত ইভান, ইনসেটে দুই ভাই

পৃথিবী তাকিয়ে আছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, স্বজন হারানোর বেদনা, সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি। এই যুদ্ধে ইতোমধ্যেই অনেক পরিবার হারিয়েছে আপনজন। অনেক পরিবার পৃথিবী থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই ঘটনাগুলো গত ১৬ মাসে এতটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে, পৃথিবীবাসী আলাদা করে মনে রাখেনি। কিন্তু তারপরও কিছু ঘটনা ভুলে যাওয়া সহজ হয় না। একটি মৃত্যুতেই কেঁপে ওঠে পৃথিবী, ভূগোল ভুলে একাত্ম হয় মানুষ; কাঁদে মন। 

তেমনই এক ঘটনায় কাঁদছে ইউক্রেনবাসী। যুদ্ধে ভাইয়ের জন্য জীবন দিয়েছে ভাই। সেই ভাইকে দেয়া হয়েছে জাতীয় বীরের মর্যাদা। ‘বিবিসি’, ‘সিএনএন’সহ বিশ্বের বড় গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে এই সংবাদ। বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে যদিও ইউক্রেনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কিংবা মৃত্যু এখন নিয়মিত ঘটনা। প্রত্যক সৈন্যের জীবন জাতির জন্য উৎসর্গ করা। প্রতিটি পরিবার তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কিছু ঘটনা পুরো শহরকে শোকাভিভূত করেছে। এমনই একটি ঘটনা যুদ্ধ করতে গিয়ে ম্যাক্সিমের মৃত্যু। ম্যাক্সিম তার ভাইকে বাঁচাতে জীবন দিয়েছে। 

গত বছর যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন দুই ভাই আর্মিতে যোগ দেয়। ম্যাক্সিমের বয়স ছিল ২২ বছর এবং ছোট ভাই ইভানের বয়স সবে ১৮ বছর হয়েছিল। আহত অবস্থায় ইভান বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সে (ম্যাক্সিম) ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। যুদ্ধে যোগদানের পর আমরা সর্বদা যুদ্ধরত ছিলাম। আমরা একই বাহিনীর একই অবস্থানের একই ইউনিটে ছিলাম। সে সব সময় আমার সাথে ছিল এবং আমি তার সাথে ছিলাম। শুধু রক্তের কারণে নয় বরং আত্মিক কারণেও এবং সে ছিল আমার সব কিছু।’

বাখমুত শহর, যেখানে দুই ভাই সর্বশেষ জীবিত অবস্থায় ছিল। সেখানেই তারা সরাসরি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ান সৈন্যদের একটি শেল ইভানের শরীরে লাগে। যুদ্ধকালীন একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইভান মারাত্মক ক্লান্ত অবস্থায় ইউক্রেনের পতাকা বহন করছে। ইভান আহত হওয়ার আগের মুহূর্তটি স্মরণ করে বলেন, ‘আমার মনে আছে আমি আবার লোড করছিলাম; আমি একটি প্রাচীরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং একটি শেল এসে আমার গায়ে লাগে। অধিক রক্তপাতের কারণে প্যারালাইজড হয়ে পড়েছিলাম এবং আমি পড়ে গিয়েছিলাম।’ 

সেই অবস্থায় ছোট ভাই ইভানকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে মেডিক্যালে নিয়ে আসে ম্যাক্সিম। ৯ ঘণ্টা  পর কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে ইভান। তখন ভাইকে হাসপাতালে রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যায় সে। এর এক সপ্তাহ পর রাশিয়ান এক স্নাইপারের গুলিতে নিহত হয় ম্যাক্সিম। ঘটনা জানার পর এক প্রতিক্রিয়ায় ইভান বলেন, ‘আমার ভাই আমার সঙ্গে আরো কয়েক দিন থেকে নিজেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে যুদ্ধে ফিরতে পারত। কিন্তু তার মধ্যে ছিল নিজ ভাইয়ের আঘাতকারী ও জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করার তাগিদ। তাই তাকে মেডিক্যাল ক্যাম্পে আটকে রাখা যায়নি।’ 

ইভান আরো বলেন, ‘ম্যাক্সিম ছিল ক্লান্ত। আমি আহত হওয়ার পর সে টানা ২০০ ঘণ্টা ঘুমায়নি, তেমন কিছুই খায়নি। এটা স্পষ্ট যে, আমাকে বাঁচাতে আর আমার আহতকারীকে শায়েস্তা করতেই আমার ভাই জীবন দিয়েছে। আমার ভাই আমাকে মরতে দেয়নি। সে আমাকে বাঁচিয়েছে।’ 

ম্যাক্সিম ও ইভানের মা লিলিয়া বলেন, গত এক বছর ধরে, আমরা ছেলেদের যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা নিয়ে ভীষণ উৎকণ্ঠায় ছিলাম। তারা প্রায়ই আমাদের আশ্বস্ত করার জন্য একটি ছোট টেক্সট করত, ‘চিন্তা করো না মা, আমরা ভালো আছি।’ বাখমুত শহরকে আমার কাছে এখন নরক মনে হচ্ছে। এটি সেই শহর যেটি আমার একটি ছেলের জীবন নিয়েছে এবং আরেক ছেলেকে গুরুতর আহত করেছে।’

‘ম্যাক্সিমের সুযোগ ছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে আসার। কিন্তু সে তার সহযোদ্ধাদের ছেড়ে যায়নি। বাখমুতে একজন রাশিয়ান স্নাইপারের হাতে নিহত হওয়ার আগে ম্যাক্সিম ২০০ ঘণ্টা বিরতি ছাড়াই যুদ্ধ করেছে। আট দিন ধরে সে খায়নি, ঘুমায়নি!’ বলেন লিলিয়া।  

বাখমুতের যুদ্ধে ম্যাক্সিম ও ইভানের সাহসিকতা প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়েছে। ম্যাক্সিমের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসা সের্গেই বলেন, ‘ম্যাক্সিম একজন নায়ক। তিনি দেবদূত। তিনি সূর্যের আলো। তিনি তার ভাইকে কখনও ছেড়ে যাননি, যদিও তিনি জানতেন যে তিনি নিজেই মারা যাবেন। ম্যাক্সিমের রক্ত আমাদের স্বাধীনতা এনে দেবে। দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতা রক্ত দিয়ে আসে।’

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়