ঢাকা     শুক্রবার   ১৭ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি মনে হচ্ছে কেন? গাছই কি সমাধান?

হৃদয় তালুকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৮, ২ মে ২০২৪   আপডেট: ১৬:২৭, ২ মে ২০২৪
৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি মনে হচ্ছে কেন? গাছই কি সমাধান?

তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। তাপমাত্রা যেন প্রতিদিন পাল্লা দিতে চায় গতদিনের তাপমাত্রার সাথে। এভাবে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে গাছ লাগানোর দিকে জোর দিচ্ছেন অনেকেই। কেউ আবার ভাবছেন, দেশের ভবিষ্যৎ তাপমাত্রা নিয়ে। বৃষ্টির আশায় অনেকেই পার করছেন দিন। অনেকেই আবার প্রশ্ন করছেন, গাছ লাগালে কি আসলেই তাপমাত্রা কমে আসবে?

এসব বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফাতেমা আক্তার ও পরিবেশবিজ্ঞানী ড. ফেরদৌস আহম্মেদ।

আমাদের দেশের আবহাওয়ার ভবিষ্যৎ কী, এই প্রশ্নের জবাবে ঢাবি অধ্যাপক ড. ফাতেমা আক্তার বলেন, আবহাওয়া হচ্ছে প্রতিদিনের তাপমাত্রা। এটা গ্রীষ্মে বা বর্ষায় এমনকি প্রতিদিন পরিবর্তন হয়। আপনি যদি জলবায়ুর কথা বলেন তাহলে সেটার ভবিষ্যৎ বলা যেতে পারে। আমাদের জলবায়ু বেশ উত্তপ্ত। গরমের সময়ে আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা পাচ্ছি। এর পেছনে যে কারণগুলো আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের ভৌগলিক অবস্থান। এর পেছনে যে কারণগুলো আছে সেসব আমাদের ভৌগোলিক লোকেশন অন্যতম। বর্ষার আগে আমাদের তাপমাত্রা উষ্ণ থাকে। পশ্চিম দিক ভারত থেকে উষ্ণ শুষ্ক বাতাস বাংলাদেশের দিকে আসে আর দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস আসে বঙ্গোপসাগর থেকে। এ দুটোর মিলনকে ড্রাই লাইন বলে। আমাদের এই ড্রাই লাইনের পশ্চিম অংশ যেখানে ভারত অবস্থিত বা যশোর, চুয়াডাঙ্গা সেখানে উষ্ণ-শুষ্ক বায়ু থাকে, তাই তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হয়। আর যেটা দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে আসে সেটা অনেক মেঘ তৈরি করে এবং বৃষ্টিপাত হয়, এতে পরিবেশ ঠান্ডা হয়। এবার আমাদের বঙ্গোপসাগর থেকে এই বাতাস আসেনি তাই গরম বাড়ছে। 

তিনি বলেন, আমরা বৈশ্বিক উন্নয়নের মধ্যে আছি। যদি বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার বরাত দিয়ে বলি, তারাও বলেছে, এই বছরটা আমাদের উষ্ণতম বছর। প্রতিবছরই তাপমাত্রা আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মধ্যে আমরা আছি।

ঢাবি অধ্যাপকের মতে, জলীয়বাষ্প না আসার কারণ হলো আমাদের বায়ু প্রবাহের ভৌগলিক অবস্থান। আমাদের ‘এল নিনো’ বা ‘লা নিনা’- এসব মাঝে মধ্যে সক্রিয় থাকে, কখনো ‘এল নিনো’ হয় কখনো ‘লা নিনা’ হয়। আমাদের ২০২৩ এর জুন থেকে ‘এল নিনো’ সক্রিয় আছে এবং এটা ট্রানজিশনের দিকে যাচ্ছে। এ কারণে জলীয়বাষ্পপূর্ণ যে বাতাস বঙ্গোপসাগর থেকে আসবে সেটি তৈরিতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, যার ফলে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস আসছে না। এই ‘এল নিনো’ কেটে যাবে। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে বর্ষার যে বৃষ্টি রয়েছে, সেটা আমরা পুরোপুরি পেতে পারি। প্রতিবছর এটি চেঞ্জ হয়। ১-২ বছরের তথ্য দিয়ে জলবায়ুর ভবিষ্যত সেভাবে বলা যায় না।

বছর বছর কি তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার যেমন আছে, সবসময় এমনটা থাকবে না। এখানে এল নিনো পূর্ব প্রশান্ত বলয়ে সক্রিয় ছিল, এখন নিউট্রালের দিকে যাচ্ছে। গরম উষ্ণ বাতাসের প্রবাহ যেটা পূর্ব দিক থোকে আসছিল, এটা এবার বন্ধ হয়ে যাবে, তখন আবার লা নিনা শুরু হবে। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমে যাবে।

বৃষ্টিপাত কেন হচ্ছে না? এ বিষয়ে তিনি বলেন, মেঘ সৃষ্টির জন্য জলীয়বাষ্পপূর্ণ পর্যাপ্ত বাতাস থাকতে হবে। সেটি না হওয়ায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে না।

গাছ লাগালেই কি আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে যাবে? এ প্রশ্নের জবাবে পরিবেশবিজ্ঞানী ড. ফেরদৌস আহম্মেদ বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছ খুবই উপযোগী। গাছ আমাদের অক্সিজেন দিচ্ছে, এটা শুধু যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে, তা কিন্তু নয়। তাপমাত্রা কমাতে গাছের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা সহজ একটা উদাহারণ দিয়ে বলছি। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, যেখানে গাছ রয়েছে সেখানে তাপমাত্রা কম অনুভব হয়, কিন্তু যেখানে গাছ নেই সেখানে গরম বেশি লাগে। এর কারণ হলো, গাছ কেবল অক্সিজেন দেয় না, বরং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে নেয়। বাতাস গরম হওয়ার পিছনে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা কার্বন দায়ী। নগরায়নের জন্য গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে, অপরটিকে কলকারখানা ও যানবাহন বেড়ে চলেছে। এর ফলে কলকারখানার ধোঁয়া ও যানবাহনের জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বনের পরিমাণ বাতাসে অনেক বেড়েছে। কার্বন অধিক হারে সূর্যতাপ ধরে রাখায় পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। গাছপালা বেশি থাকার সুবিধা হলো, অতিরিক্ত কার্বন গাছ গ্রহণ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। গাছপালা যত বেশি থাকবে, বাতাস থেকে ততবেশি কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমে যাবে। এর ফলে তাপমাত্রা কমে যেতে বাধ্য।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্র (এসডিজি) পূরণে বিশ্বে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের ১৭টা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার মধ্যে বনায়ন রয়েছে। ঢাকা শহরের কথা বললে, এর অবস্থা আসলেই খারাপ, বাসযোগ্য নয়। যেকোনো জায়গা বাসযোগ্য করার জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ গাছপালা থাকা প্রয়োজন, কিন্তু ঢাকায় তা নেই। এছাড়া জলাশয়ও একটি বড় কারণ। আমরা  খাল, বিল, নদী-নালা সব ভরাট করে ফেলছি। জলাশয় তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

কোনো এলাকায় তাপমাত্রা যদি ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলে ‘ফিলস লাইক’-এ তার চেয়ে তিন থেকে চার ডিগ্রি বেশি দেখানো হয়। অর্থাৎ প্রকৃত তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি হলেও গরম অনুভূত হয় ৪০ বা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এ বিষয়টা কেন হয়? এ বিষয়ে ড. ফেরদৌস বলেন, তাপমাত্রার ক্ষেত্রে মূলত বাতাসের তাপমাত্রা মাপা হয়ে থাকে। কিন্তু রাস্তাঘাটে বের হলে যে তাপ অনুভূত হয় সেখানে বাতাস ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ের প্রভাব থাকে। এটিই হচ্ছে, ফিলস লাইক তাপমাত্রা। অর্থাৎ বাতাসের আর্দ্রতা ও গতিবেগের কারণে মূল তাপমাত্রার চেয়েও বেশি গরম বা ঠান্ডা অনুভূত হয়ে থাকে। যেসব এলাকায় যানবাহন, কলকারখানা এবং ভবনের পরিমান বেশি সেখানে মূল তাপমাত্রার চেয়ে অনুভূত তাপমাত্রা বেশি থাকে। আর যেসব এলাকায় গাছপালা ও জলাধার বেশি, সেসব এলাকায় মূল তাপমাত্রা ও অনুভূত তাপমাত্রার ব্যবধান কম হয়।

গরমের সময়ে এই ফিলস লাইক বা অনুভূত তাপমাত্রা যেমন বেশি থাকে, তেমনি শীতের সময় ঠিক উল্টো। তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও তার ‘ফিলস লাইক’ পৌঁছে যায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অর্থাৎ, ওই এলাকার মানুষ আসলে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো ঠান্ডা অনুভব করেন।

হৃদয়/ফিরোজ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়