ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়াতে দরকার ‘পজিটিভ প্রচারণা’

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৬, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪  
কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়াতে দরকার ‘পজিটিভ প্রচারণা’

দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ভেজাল খাদ্যগ্রহণ, ধূমপান, যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ব্যথানাশক সেবনের কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

দেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে সরকারি হাসপাতালে খরচ হয় তিন লাখ টাকার মতো। অপরদিকে, দেশের বাইরে ভারতে কিংবা চীনে গেলে এই খরচ পড়ে ৪০ লাখ টাকা। চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু প্রচারণার অভাবে এবং সচেতনতা না থাকায় মানুষ এখনও বিদেশে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাচ্ছেন। বাংলাদেশ রেনাল ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বের ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে ২৪ লাখ মারা যাচ্ছেন। আর দেশে কিডনি রোগে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন।

প্রতিনিয়ত দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থা। সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশ (এসওটি), বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন, কিডনি ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি ১০টি প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খরচ অনেক কম। ইতোমধ্যে সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)।

তথ্য মতে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকারি এই হাসপাতালে তুলনামূলক অনেক কম খরচে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। বিএসএমএমইউতে বর্তমানে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে এই চিকিৎসা করানো সম্ভব বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

বিএসএমএমইউ সূত্রে জানা যায়, বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পাশাপাশি তাদের অধীনে থাকা সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালেও কিডনি প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে। আগে বিএসএমএমইউতে সপ্তাহে একটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন হতো। বর্তমানে সপ্তাহে দুই প্রতিষ্ঠান মিলে হচ্ছে দুটি। তবে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে দুই হাসপাতালে মাসে ৪টি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে।

মার্চ মাস থেকে প্রতি মাসে ৪টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে বলে জানান বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমানে বিএসএমএমইউ এবং সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রয়োজনমত দক্ষ জনবল ও সাপোর্ট সার্ভিস আমাদের রয়েছে। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আলাদা করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট স্যুইট, অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ আছে এবং তা উন্নত বিশ্বের মতো সমপর্যায়ের।

উপাচার্য বলেন, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট একক কোনো চিকিৎসকের কাজ নয়, এটি একটি দলগত কাজ। এতে একজন নেফ্রোলোজিস্টের বিরাট ভূমিকা থাকে। প্রি-অপারেটিভ ও পোস্ট অপারেটিভ অনেক কাজ থাকে। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের যে মূল কাজটি হয় সেখানেও তিনটি আলাদা দল কাজ করে। পুরো দলে ৭ থেকে ১০ জনের মতো কাজ করেন সার্জারির সময়। একটি টিম কিডনি দাতা থেকে কিডনি গ্রহণ করে। অন্য টিম সেটিকে পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করে। আরেক টিম চূড়ান্তভাবে রোগীর দেহে কিডনি প্রতিস্থাপন করে।

দেশে সর্বপ্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন বিএসএমএমইউতে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত এর সংখ্যা তেমন বাড়েনি। এ প্রসঙ্গে প্রক্টর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, বিএসএমএমইউ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশে যারা কিডনি প্রতিস্থাপন করছেন- তাদের বেশিরভাগই এখান থেকে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছেন। 

বিএসএমএমইউতে এখন পর্যন্ত ৬১০টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জয়েন্টলি কাজ করছে। এদের অনেক হাসপাতাল, যেমন শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট নতুন করে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে চায়। তারা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে তাদের সব রকমের লজিস্টিক সাপোর্ট এবং প্রশিক্ষণ বিএসএমএমইউ থেকে দেওয়া হবে।

হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, আরেকটা সংশোধন হয়েছে ২০১৯ সালের এক রিটে উচ্চ আদালত ইমোশনাল ডোনার হিসেবে কিডনি দেওয়ার জন্য অর্ডার দিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। তবে মন্ত্রণালয় এখনো এই রায় আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেনি। এই আইন হলে সবাই সবাইকে দিতে পারতো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন কম হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে, একটি বড় দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য। অনেক ভালো পেশার মানুষও এর সঙ্গে জড়িত। তারা চায় না দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন, ক্যাডাবেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট সফল হোক। তাদের কারণে রোগীরা প্রতিনিয়ত বিদেশে গিয়ে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে কিডনি প্রতিস্থাপন করছে। দেশে একটা ভালো কাজ শুরু হলে নানা ধরনের সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপরও আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করালে কিডনির বেসিক কিছু ফাংশন কাজ করে। সব ফাংশন কাজ করার জন্য ট্রান্সপ্ল্যান্টের বিকল্প নেই বলে জানান অধ্যাপক ডা. রফিকুল আলম। তিনি বলেন, আমাদের দেশে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য বড় অন্তরায় হলো, এ বিষয়ে তেমন প্রচারণা নেই। দ্বিতীয়ত ডোনার নেই। অর্থ নেই, সাপোর্ট নেই, তারপরও রয়েছে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা। পজিটিভ অ্যাটিচ্যুড, পজিটিভ প্রচার না পেলে দেশে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট কমে যাবে। মানুষজন বিদেশমুখী বেশি হবে। সে কারণে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট সাকসেসফুল করতে সবার সহযোগিতা লাগবে।

কিডনি রোগীর জীবন রক্ষায় ২২ ধরনের আত্মীয় নিজের কিডনি দিতে পারেন। মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন ২০১৮ অনুযায়ী, জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয় হচ্ছেন- মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন। এই তালিকার বাইরে অন্য কারও শরীর থেকে কিডনি নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করার আইনি কোনো সুযোগ আমাদের দেশের আইনে নেই।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়