ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ধীরে চলছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার, সুপারিশ বাস্তবায়নে নেই অগ্রগতি

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩০, ৮ আগস্ট ২০২৫  
ধীরে চলছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার, সুপারিশ বাস্তবায়নে নেই অগ্রগতি

বছরের পর বছর ধরে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিপরীতে যখন একটি সাহসী সংস্কার পরিকল্পনা সামনে আসে, তখন তা আশা জাগায়। কিন্তু সেই আশাই এখন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে হতাশায়।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে গঠিত ১২ সদস্যের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গত ৫ মে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৩২ দফা সুপারিশসহ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। 

আরো পড়ুন:

সরকারি হাসপাতালের সেবা সময় বাড়ানো, বেসরকারি হাসপাতালে সেবামূল্য নির্ধারণ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিতসহ একাধিক কাঠামোগত সংস্কার প্রস্তাব করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

কিন্তু সেই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তিন মাস পরও কোনো বৈঠক হয়নি। গঠিত হয়নি টাস্কফোর্স বা আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিও। ফলে কমিশনের সদস্যরা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কার উদ্যোগ কেবল কাগজে আটকে থাকলে স্বাস্থ্য খাতের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন কখনোই সম্ভব নয়।

বিলম্বিত উদ্যোগ, নেই বাস্তবায়নের কাঠামো
৬আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সমন্বয় সভা হয়। এটি এই বিষয়ে প্রথম বৈঠক। এতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিএআইএমএ) অংশীদার সংস্থাগুলোকে ডাকা হয়। 

সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। সেখানে একটি প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা তৈরির বিষয়ে আলোচনা হয়।

কিছু প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব
কমিশনের মতে, সব সুপারিশ বাস্তবায়নে সময় লাগতে পারে ১৮ থেকে ২৪ মাস। তবে অন্তত ১০টি সুপারিশ তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে, সরকারি হাসপাতালে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ, ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা গড়ে তোলা এবং বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনা।

কমিশনের প্রধান ডা. এ কে আজাদ খান সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, এই সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে একটি জাতীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা জরুরি, যা সরাসরি সরকারকে রিপোর্ট দেবে এবং প্রতিটি পদক্ষেপ তদারকি করবে।

তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় অপরিহার্য। এটি কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একক দায়িত্ব নয়, এটি একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

সমন্বয়ের ঘাটতি স্পষ্ট
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কমিশনের প্রতিবেদনটি একটি দিকনির্দেশক দলিল। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে গতি প্রত্যাশিত, তা অনুপস্থিত। সাতটি স্তম্ভে সংস্কারের কথা বলা হলেও মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন নেই।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফিদা মেহরান বলেন, “আমরা চাই না সংস্কার পরিকল্পনাটি রাজনৈতিক বক্তব্যে আটকে থাকুক। এখনই দরকার একটি ট্রানজিশন প্ল্যান, যা বাস্তবায়নের পথ নির্ধারণ করবে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার কেবল প্রযুক্তি কিংবা নতুন অবকাঠামোর প্রশ্ন নয়। এটি নেতৃত্ব, জবাবদিহি ও জনগণের সম্পৃক্ততার সঙ্গে যুক্ত।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. সাইদুর রহমান বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সব শাখা ও সংস্থার প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, “সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কমিশনের সুপারিশ ছাড়াও আমরা স্বাস্থ্যখাতকে এগিয়ে নিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ, এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ান, জনবল কাঠামোতে শৃঙ্খলা আনা ইত্যাদি।”

বিএআইএমএর প্রস্তুতি
বিএআইএমএ সভাপতি এস এম সাইফুর রহমান বলেন, “ওষুধের কাঁচামাল দেশেই উৎপাদনের জন্য আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করছি। প্রস্তাবনা জমা দেব।”

যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে: সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বিকাল ৫টা পর্যন্ত করা; বেসরকারি হাসপাতালে সেবামূল্য নির্ধারণ করা; ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সীমিত করা; অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন  করা এবং জাতীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা।

কমিশনের এক সদস্য বলেন, “আমরা এক বছর সময় চেয়েছিলাম বাস্তবায়নের রোডম্যাপ দেখতে। কিন্তু তিন মাসেও একটা বৈঠক না হলে সেটাকে উদাসীনতা না বলে কী বলব।”

“জনগণের প্রত্যাশা আর স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাস্তবতা- এই ব্যবধান কমাতে হলে এখনই গতি আনতে হবে উদ্যোগে। নয়তো সুপারিশগুলো শুধু আরেকটি প্রতিবেদন হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা করে নেবে, পরিবর্তন নয়,” যোগ করেন তিনি।

ঢাকা/এএএম/রাসেল 

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়