ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

কেবল ভাষার ভিত্তিতে কাউকে বিদেশি বলা যায় না: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

কলকাতা ব্যুরো || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪২, ৩০ আগস্ট ২০২৫   আপডেট: ১১:৪৩, ৩০ আগস্ট ২০২৫
কেবল ভাষার ভিত্তিতে কাউকে বিদেশি বলা যায় না: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

বিজেপি শাসিত ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য তাদের বাংলাদেশি তকমা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পুশব্যাকের অভিযোগও উঠছে। আর এই বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দেশটির শীর্ষ আদালত। কেবলমাত্র ভাষার ভিত্তিতে কোনো নাগরিককে বিদেশি নাগরিক বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট মতামত চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, শুধুমাত্র ভাষা ভারতে কাউকে বিদেশি নাগরিক হিসেবে গণ্য করার ভিত্তি হতে পারে না। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিশেষ করে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রকে সরকারকে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ (এসওপি) মেনে চলার পরামর্শ দেন শীর্ষ আদালত। 

সম্প্রতি বাংলায় কথা বলার জন্য বাংলাদেশে পুশব্যাক করার অভিযোগ উঠে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের বাসিন্দা অন্তঃসত্ত্বা সোনালী বিবিকে। দিল্লিতে স্বামী-সন্তান নিয়েই থাকতেন সোনালী। পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে সেখানে কাজ করতেন তারা। কিন্তু গত জুন মাসে তাদের আটক করে দিল্লি পুলিশ। ওই সময় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। সোনালী বিবি সহ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করে পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ড ও কয়েকটি এনজিও। শুক্রবার (২৯ আগস্ট) সেই মামলার শুনানি ছিল শীর্ষ আদালতে। আদালতের বিচারপতি সূর্য কান্ত, জয়মাল্য বাগচী এবং বিপুল এম পাঞ্চোলির এক ডিভিশন বেঞ্চে ওঠে সেই মামলা। 

ওই শুনানিতে ওয়েলফেয়ার বোর্ড সহ এনজিওর প্রতিনিধি হিসেবে আদালতে সওয়াল করছিলেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে ছিলেন সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা। 

শুনানি চলাকালীন সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ ইস্যুতে সরগরম হয়ে ওঠে আদালতের কক্ষ। শীর্ষ আদালতে এই মামলার আবেদনের বিরোধিতা করে সলিসিটার জেনারেল বলেন, আদালতের উচিত এই সংগঠনের দ্বারা দায়ের করা আবেদনগুলো গ্রহণ না করা। কারণ কিছু রাজ্য ওই সংগঠনগুলোকে সমর্থন দিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া আদালতের সামনে কোনো ব্যক্তিগত অভিযোগকারী উপস্থিত নেই। আমরা জানি কীভাবে কয়েকটি রাজ্য সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের উপর নির্ভর করে। এতে জনসংখ্যার পরিবর্তন একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আবেদনকারী বোর্ড এবং অন্যান্য এনজিওর পক্ষে উপস্থিত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের কথা উল্লেখ করে সলিসিটর জেনারেল বলেন, ভূষণের মতো এই ধরনের  ব্যক্তিদেরকে অভিযোগকারীদেরকে আদালতে আবেদন করতে সাহায্য করা উচিত, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি যেখানে বড়, সেখানে লোকেদের সাহায্য করা উচিত।

জবাবে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী মেহতাকে জিজ্ঞাসা করেন, “অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে যেভাবে মেক্সিকো সীমান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে উঁচু পাঁচিল নির্মাণ করেছে, ঠিক সেভাবেই অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও কি বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্তবর্তী এলাকায় উঁচু পাঁচিল নির্মাণ করতে চায়?” 

মেহতা উত্তর দেন, “অবশ্যই না। কিন্তু কোনো ব্যক্তিগত অভিযোগকারী নেই। ভারত সরকার কীভাবে আবেদনে করা অস্পষ্ট অভিযোগের জবাব দিতে পারে? কোনো ব্যক্তিকে এসে বলতে দিন যে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি যে, অভিবাসীরা আমাদের সম্পদ খেয়ে ফেলবে না। আমরা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করতে পারি না। এমন এজেন্ট আছে যারা দেশে অবৈধ প্রবেশকে সহজ করে তোলে।” 

বিচারপতি বাগচী তখন মেহতাকে বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা, জাতির অখণ্ডতা এবং আপনি যেমন বলেছেন আমাদের সম্পদ সংরক্ষণের প্রশ্ন রয়েছে। মনে রাখা দরকার যে একই সাথে, আমাদের একটি সাধারণ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার রয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবি ভাষাভাষী ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর ‘একই সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত’ ঐতিহ্যের মিল রয়েছে। সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষের ভাষা এক হলেও দুটি আলাদা রাষ্ট্র। আমরা চাই ইউনিয়ন এই বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করুক।” 

সলিসিটর জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর প্রশ্ন ছিল, “কোনো এক ব্যক্তির ভাষা দিয়ে তার নাগরিকত্ব যাচাই বা বিদেশি হিসেবে অনুমান করা যায় কিনা! আমরা চাই আপনি পক্ষপাতদুষ্টতা স্পষ্ট করুন।”

সোনালী বিবির পুশ ব্যাকের প্রসঙ্গটি তুলে আবেদনকারীদের পক্ষে উপস্থিত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এর যুক্তি, “সীমান্ত কর্তৃপক্ষ কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই লোকদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। এমনকি একটি ক্ষেত্রে, কলকাতা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস আবেদন দায়ের করা সত্ত্বেও একজন গর্ভবতী মহিলাকে জোর করে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।”

প্রশান্ত ভূষণের অভিযোগ, নাগরিক প্রমাণপত্র যাচাই না করে, শুধুমাত্র ভাষার ভিত্তিতে ওই নারীকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়েছিল। এমনকি, এর আগে এই মামলায় নোটিষ ইস্যু করলেও কেন্দ্রীয় সরকার কোনো জবাব দেয়নি বলেই দাবি করেন তিনি। 

আদালতকে ভূষণ জানান, “ওই নারীকে জোর করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে- তিনি গর্ভবতী- কোনো প্রমাণ ছাড়াই যে তিনি একজন বিদেশি। তারা (কেন্দ্র) বলছে, বাংলা ভাষা একটি বাংলাদেশি ভাষা। অতএব, যারা বাংলা ভাষাভাষী তারাই বাংলাদেশি। কোনো ব্যক্তি বিদেশি কিনা তা নির্ধারণ না করে কীভাবে কোনো কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তাড়িয়ে দিতে পারে? বাংলাদেশে প্রবেশের পরই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ওই নারীকে ভারতীয় বলে তাদের বিদেশি আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করে।” 

বিচারপতি বাগচী তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মেহতাকে বলেন, ‘কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বললেই কি তাকে বিদেশি বলা হবে?” একই সুরে বিচারপতি সূর্য কান্তের প্রশ্ন, “বাংলায় কথা বললেই তাকে বাংলাদেশি বলা হচ্ছে?” এ নিয়ে সরকারের কাছ থেকে ব্যাখ্যা তলব করেছে তিন বিচারপতির বেঞ্চ। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর এই ব্যাপারে সরকারকে তার বক্তব্য জানাতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেতৃত্ব।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট একটি জনস্বার্থ মামলার সূত্রে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে যুগান্তকারী নির্দেশ ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সীমান্ত রাজ্য হিসেবে বাংলার ঐতিহাসিক ভূমিকা স্বীকার করে প্রজন্মের পর প্রজন্মে বাংলা কীভাবে আশ্রয়, ভরসা ও সংস্কৃতির আশ্রয়স্থল হয়েছে, তার স্বীকৃতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আজকে মিলেছে। আটক হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটা বড় ভরসার জায়গা আজ তৈরি হলো।”

ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়