ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

তাজরীন ট্র্যাজেডি মামলা, ১০ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৪ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ১১:২৭, ২৪ নভেম্বর ২০২২
তাজরীন ট্র্যাজেডি মামলা, ১০ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

ফাইল ছবি

আগুনে পুড়ে ১১২ শ্রমিকের মৃত্যুর মামলায় সাক্ষ্য ১০৪ জন। সাত বছর আগে মামলার চার্জগঠন করা হয়। এই সাত বছরে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১১ জন। ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টস কারখানায়। দেখতে দেখতে কেটে গেলো ১০ বছর।

এই দীর্ঘ সময়ে বিচার ও ক্ষতিপূরণের আশা হারিয়ে ফেলেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। ইতিমধ্যে অনেক শ্রমিক পরিবার ছেড়েছেন আশুলিয়া। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, শ্রমিকরা সাক্ষী দিতে আদালতে আসছেন না। তাই মামলার অগ্রগতিও হচ্ছে না।

এদিকে দীর্ঘদিনেরও মামলা শেষ না হওয়ায় আসামিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন তাদের আইনজীবীরা। অন্যদিকে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে গেলে তাদের হুমকি দিচ্ছেন গার্মেন্টসের মালিক দেলোয়ার ও তার স্বজনরা।

তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম একটি মামলা করেন। ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। এখন পর্যন্ত মাত্র ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দিলারা আলো চন্দনার আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। তবে ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেনি। এজন্য আদালত আগামী ১ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিধ ধার্য করেন আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ. কে. এম. শাহ নেওয়াজ বলেন, আমরা প্রসিকিউশন পক্ষ ও বিজ্ঞ আদালত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। রাষ্ট্রপক্ষ প্রতি ধার্য তারিখে সাক্ষীদের মোবাইল ফোনে এবং সমনের মাধ্যমে সাক্ষ্যর বিষয়ে তাদের জানায়। কিন্তু সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত না হওয়ার কারণে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাক্ষীরা মুখে বলে বিচার চাই। কিন্তু তারা আন্তরিকভাবে বিচারের জন্য সাক্ষী দিতে আদালতে আসেন না। তারা আন্তরিক না। আন্তরিক হলে তারা সংঘবদ্ধভাবে আদালতে আসতো। প্রসিকিউশন সর্বত্রই সাক্ষীদের সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও যারা আদালতে এসে সাক্ষী দিয়ে যান তাদেরও বলা হয় অন্যদের নিয়ে আসো। আমরা প্রসিকিউশের পক্ষ থেকে নিঃস্বার্থভাবে বিচার প্রার্থীদের সহযোগিতা করবো।

তিনি আরও বলেন, মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে কত বছর সেটা বলা কঠিন। মামলার প্রসিডিউর অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে। মামলার সাক্ষী দ্রুত আসলে ইচ্ছা করলে দুই মাসের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা যায়। সাক্ষ্য গ্রহণে যত বিলম্ব হবে, মামলা শেষ করতে তত বিলম্বিত হবে। সাক্ষী যত দ্রুত হবে মামলা নিষ্পত্তি তত দ্রুত হবে। একাধিকবার সমন দেওয়ার পরেও যারা সাক্ষী দিতে আদালতে আসেন না তাদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় দশ জনের অধিক সাক্ষীকে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তারপরও তারা আসেন না। আশা করছি, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলার বিচার দ্রুত শেষ হবে।

এদিকে, আসামি দেলোয়ার হোসেন ও মাহমুদার আইনজীবী হেলেনা পারভীন বলেন, মামলার সাক্ষী না আসার কারণে বিচার শেষ হতে বিলম্ব হচ্ছে। এক তারিখে সাক্ষী আসে তো অন্য তারিখে আসে না। সাক্ষীরা অধিকাংশ গার্মেন্টস কর্মী। এজন্য ঠিকমত সাক্ষীদের খুঁজে পাচ্ছে না রাষ্ট্রপক্ষ। আবার অনেকেই আগের জায়গা ছেড়ে অন্যত্রে চলে গেছেন। অনেকে সাক্ষী দিতে আসছেন না। এতে আরও বিলম্বিত হচ্ছে মামলাটি।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি চলমান থাকায় আসামিদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো আসামি ঠিকমত আইনজীবীর ফি পর্যন্ত দিতে পারছেন না। আসামিরাও বিচারপ্রার্থী। এই মামলার জন্য তাদের প্রতি মাসেই আদালতে আসতে হয়। এর ফলে পারিবারিক, মানসিক, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। আমরাও ন্যায়বিচার চাই। আশা করি, সাক্ষ্য, প্রমাণ শেষে আসামিরা এই মামলা থেকে খালাস পাবেন।

এদিকে সাক্ষীদের আদালতপাড়ায় হুমকি দিচ্ছেন মালিক ও তার স্বজনরা। হুমকির বিষয়ে তাজরীনের সুপারভাইজার মিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে আদালতে যাই। সাক্ষ্য শেষে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়।

মামলার পর্যবেক্ষণে থাকা গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সবুজ বলেন, গত ২১ জুন মামলার শুনানিতে আদালতে যাই। সেখানে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১২ পোশাক শ্রমিক ও কর্মী নির্মমভাবে নিহত হন। আহত হন ১০৪ শ্রমিক। গার্মেন্টস কারখানাটিতে এক হাজার ১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। নিহত ১১১ জনের মধ্যে তৃতীয় তলায় ৬৯ জন, চতুর্থ তলায় ২১ জন, পঞ্চম তলায় ১০ জন, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যান ১১ জন। লাশ শনাক্ত হওয়ায় ৫৮ জনকে তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।  ৫৩ জনের লাশ শনাক্ত না হওয়ায় তাদের অশনাক্ত অবস্থায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওই ঘটনায় আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের পর ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির পুলিশের ইন্সপেক্টর একেএম মহসীনুজ্জামন। মামলায় চার্জশিটভুক্ত মোট ১৩ আসামির মধ্যে ৪ জন পলাতক। ৯ জন জামিনে রয়েছেন।

আসামিরা হলেন-প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপার ভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও কোয়ালিটি ম্যানেজার শহীদুজ্জামান দুলাল। এদের মধ্যে আল-আমিন, রানা, শামীম ও মোবারক পলাতক রয়েছেন।

/মামুন/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়