ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বর্ষবরণে যৌন হয়রানি: ৯ বছরেও শেষ হয়নি বিচারকাজ

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৬, ১৪ এপ্রিল ২০২৪  
বর্ষবরণে যৌন হয়রানি: ৯ বছরেও শেষ হয়নি বিচারকাজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচারকাজ দীর্ঘ ৯ বছরেও শেষ হয়নি। ঘটনা তদন্তে দীর্ঘ সময় নেওয়া এবং আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলাটি দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে। সবকিছু শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। তবে, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি জানিয়ে মামলাটি রায় থেকে উত্তোলন করে সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষীদের হাজির করে দ্রুত মামলাটির বিচার শেষ করার প্রত্যাশা রাষ্ট্রপক্ষের।

২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল টিএসসিতে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে যৌন হয়রানি সংঘটিত হয়। কিন্তু, এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি আজও। ঘটনায় জড়িত আট আসামির মধ্যে সাতজনকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মো. কামাল নামের এক আসামির বিচার চলছে। 

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক শওকত আলীর আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ১৯ জুন মামলাটিতে একমাত্র আসামি কামালের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি মামলার বাদী আবুল কালাম আজাদ সাক্ষ্য দেন। গত ১৫ জানুয়ারি পুলিশের উপ-পরিদর্শক মিরাজ হোসেন খান আদালতে সাক্ষ্য দেন। নয়জনের সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষ্য সমাপ্ত করা হয়। ওইদিন আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন আসামি কামাল। পরে গত ২৩ জানুয়ারি যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ধার্য করেন। তবে, ওই দিন রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ধার্য করা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করার আবেদন করে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি রায় থেকে উত্তোলন করে সাক্ষ্যের জন্য রাখা হয়। আগামীকাল সোমবার (১৫ এপ্রিল) মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।

মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, ‘মামলাটিতে ৩৪ সাক্ষীর মধ্যে ৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। রায়ের পর্যায়ের আসে মামলাটি। তবে, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন করি। পরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলাটি রায় থেকে উত্তোলন করে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাখা হয়। আমরা রাষ্ট্রপক্ষে আছি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি পরিচালনা করা হচ্ছে। যে কয়জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তাতে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে আরও জোরালোভাবে অভিযোগ প্রমাণ করতে আমরা পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, ভিডিও ফুটেজে আসামি কামালের সম্পৃক্ততা দেখা গেছে। সাতজনকে চেনার মতো অবস্থা নেই। কামালকে একটু বোঝা যায়। প্রথমে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরে আবার মামলাটি তদন্তে পাঠানো হয়। কামালকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

তিনি বলেন, এটা চাঞ্চল্যকর মামলা। সাক্ষীদের হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করব। আশা করছি, আসামির সর্বোচ্চ সাজা হবে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আনিসুর রহমান বলেন, মামলার এজাহারে কামালের নাম ছিল না। পুনঃতদন্তে চার্জশিটে তার নাম এসেছে। সে ডায়াবেটিস রোগী। গরিব মানুষ। লালবাগের খাজী দেওয়ানে সে ফুটপাতে সবজির ব্যবসা করে। যেহেতু সে ডায়াবেটিস রোগী, এজন্য ওইদিন সে বের হয়েছিল হাঁটাহাটি করার জন্য। ওই ঘটনা ঘটার পরে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায়। এরপর কামাল সেখানে হাঁটাহাটি করতে যায়। সেখানে যে কোনো ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে কামাল কিছু জানতো না। সে হেঁটে এসেছিল আর তার ছবি ওই ভিডিও ফুটেজে এসেছে। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ভিডিও ফুটেজে এমন কিছু আসেনি যে, সে কাউকে ধরছে, টানছে বা শ্লীলতাহানি করছে। ভিডিও ফুটেজে তার ছবি আসার কারণে তাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। সে ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানে না।’

তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৃত আসামিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেনতেনভাবে চার্জশিট দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে মামলায় সম্পৃক্ত করেছে। ন্যায়বিচার সবার প্রত্যাশা। প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার না করে অযথা ভুলভাবে তাকে মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। আমরা ন্যায়বিচার আশা করছি। প্রকৃত সত্যটা উদঘাটিত হোক। নিরপরাধ মানুষ অযথা যেন সাজা না পায়, সে আশায় আছি।’

তিনি আরও বলেন, মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ নয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের জেরা করা হলে আসামির বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছিল। সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করে রায় ঘোষণার জন্য ছিল। কিন্তু, রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি রায় ঘোষণা থেকে উত্তোলন করে ফের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আবেদন করে। আদালত তা মঞ্জুর করেন। আশা করি, কামাল ন্যায়বিচার পাবেন এবং বিচারে খালাস পাবেন।

২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে কয়েকজন নারীকে যৌন হয়রানি করা হয়। ওই ঘটনায় ভিকটিমদের পক্ষ থেকে কেউ মামলা না করায় শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। শাহবাগ থানার পুলিশ মামলাটি কয়েকদিন তদন্তের পরই তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) দেওয়া হয়।

মামলার এক মাস পর ১৭ মে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও থেকে আটজন যৌন হয়রানিকারীকে শনাক্ত ও তাদের ছবি পাওয়ার কথা জানান তৎকালীন পুলিশ প্রধান একেএম শহীদুল হক। তাদের ধরিয়ে দিতে ১ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। কিন্তু, তাদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাতে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনও গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে শনাক্তকৃত আসামিদের মধ্যে মো. কামাল (৩৫) গ্রেপ্তার হলে তাকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন করা হয়।

২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক একমাত্র আসামি কামালকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৭ সালের ১৯ জুন ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার ওই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। মামলাটিতে ৩৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র নয়জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। 

মামলার একমাত্র আসামি কামাল জামিনে আছেন। হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পেয়েছেন।

/রফিক/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়