ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যেভাবে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে পদ্মা সেতু

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ১০ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৯:২৪, ১০ ডিসেম্বর ২০২০

আগামী শনিবার (১২ ডিসেম্বর) পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের ৫ বছরপূর্তি।  এর ২ দিন আগেই বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) বসলো সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাওয়া প্রান্তে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানোর কাজ শুরু হয়, তখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পদ্মার তীরে অপেক্ষা।  অনেকে ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে নেমেছেন পদ্মা নদীতে।  অনেকে সেতুর কাছাকাছি চরে অবস্থান করেছেন। সবাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুই প্রান্ত যুক্ত হওয়ার দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়।

বেলা ১২টার দিকে পদ্মা সেতুর সর্বশেষ (৪১তম স্প্যান) বসানো সম্পন্ন হয়। এর মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো ছয় হাজার ১৫০ মিটারের পুরো সেতু। সংযোগ হলো মাওয়া ও জাজিরা প্রান্ত।

পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প ব্যবস্থাপকের (মূল সেতু) দায়িত্ব পালন করছেন দেওয়ান আবদুল কাদের।  তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা ২ মিনিটের দিকে সেতুর শেষ স্প্যান বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মূল নদীতে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে অবস্থিত ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয়েছে ৪১তম স্প্যান ‘টু-এফ’।’’

স্প্যান বসানোর মধ‌্য দিয়ে স্বপ্নের শুরু
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।  এদিন পদ্মা সেতুতে বসে প্রথম স্প্যান।  এরপর ২০১৮ সালে বসানো হয় আরও ৪টি স্প্যান। ২০১৯ সালে ১৪টি, ২০২০ সালে বসানো হয় ২২টি স্প্যান। প্রথম স্প্যান থেকে ধারাবাহিকভাবে বসিয়ে শেষ পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ৩৮ মাস ১০ দিন।

যেভাবে বসলো শেষ স্প‌্যান
কাজের গতি এগিয়ে রাখতে বুধবার (৯ ডিসেম্বর) থেকেই ৪১তম স্প্যানকে নির্ধারিত পিলারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।  বুধবার বিকেল ৫টা ৫ মিনিটের দিকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে স্প্যানকে বহন করে নিয়ে যায় তিন হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার ‘তিয়ান-ই’ ভাসমান ক্রেন।  বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে ১৫০ মিটারের ধূসর স্প্যান নির্ধারিত পিলারের কাছে পৌঁছালে সেখানে ভাসমান ক্রেনের নোঙর করার কাজও সেরে ফেলেন প্রকৌশলী-শ্রমিকরা।  সারারাত সেখানেই রাখা হয় স্প্যানবহনকারী ক্রেনকে।

১০ ডিসেম্বর সকাল। পদ্মা নদীতে ঘন কুয়াশার উপস্থিতির মধ্যে শুরু হয় স্প্যান বসানোর কাজ।  সকালে স্প্যানকে দুই পিয়ারের মধ্যবর্তী স্থানে নোঙর করার কাজ করা হয়। এরপর পিয়ারের উচ্চতায় তোলা হয় স্প্যানকে।  রাখা হয় দুই পিয়ারের বেয়ারিংয়ের ওপর।

বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা
পদ্মা সেতুর প্রকৌশলী সূত্র জানায়, শেষ স্প্যান বসানোর হচ্ছে বলে দুই পাশে ছিল বাংলাদেশ ও চীনের জাতীয় পতাকা। পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি ও চীনা ভাষায় লেখা,  ‘বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি শ্রম শক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে।  সেতুর ৪১টি ইস্পাতের তৈরি স্প্যান সোনার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে সংযুক্তির মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখবে’।

পদ্মা সেতুর অবকাঠামো
পদ্মা সেতু দেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে রয়েছে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর আববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর ৪১টি স্প‌্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছে এই সেতু।  এই প্রকল্পে অধিগ্রহণ করা মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যান্য দাতাও সেই পথ অনুসরণ করে। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। অবশ‌্যই এসব অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলা খারিজ করে দেন। 

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু
বর্তমানে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এইকম’র ডিজাইনে পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার এসে সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করে। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। তখন পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়িয়েছিল সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর ব্যয় আরও ১৪০০ কোটি টাকা বাড়ে।  এতে মোট ব্যায় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

নির্মাণকাজ ও প্রতিষ্ঠান
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে।  এরপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ধাপে ধাপে স্প্যান বসতে থাকে।  সেতুর কাজে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, শ্রমিকরাও শেষ স্প্যান বসিয়ে খুশি।  এ বছর করোনা পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে চার মাস স্প্যান বসানো হয়নি। কিন্তু, গেল দুই মাসে আটটি স্প্যান বসানো হয় এবং এ মাসে বসে দুইটি স্প্যান। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রয়োজন হবে দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব।  এছাড়া, দুই হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে।  মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বসানো স্প্যানগুলোতে এসব স্ল্যাব বসানো হচ্ছে। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

ঢাকা/এসবি/এনই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়