ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

চাল নিয়ে চালবাজি

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২১, ২১ মে ২০২২   আপডেট: ১৭:৫৭, ২১ মে ২০২২
চাল নিয়ে চালবাজি

ছবি: রাইজিংবিডি

তেল, পেঁয়াজ, চিনির পর এবার চালের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সপ্তাহান্তে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৫ টাকা। মিল মালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন কনজ্যুমার কোম্পানি প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে ভরা মৌসুমে চালের এই দাম বাড়ার অন্যতম কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মিলে লেবার সঙ্কট, বন‌্যায় বিভিন্ন জেলায় ধানের ক্ষতি হওয়া, বৃষ্টি ও বন‌্যার পানিতে মিলারদের গুদামে থাকা ধান ও চাল ভিজে নষ্ট হওয়া; ধানের দাম ও পরিবহন ব্যয় বাড়াসহ কয়েকটি কারণ।

চালের দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা বিষয়ে রাজধানীর কাওরান বাজার কিচেন মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. লোকমান হোসেন বলেন, পুঁজিবাদী কয়েকটি কোম্পানির দখলে শুধু চাল নয়; এদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তেল, পেঁয়াজ, চিনি, আটা-ময়দার মতো নিত্যপণ্য। এদের টাকার সঙ্গে মিল মালিকরা পেরে ওঠেন না।’

এসব কোম্পানিরা একজোট হয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। আমদানি, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, মূল্য নির্ধারণ- সবকিছুই এসব কোম্পানিরা বসে নির্ধারণ করেন। ‘ওপর মহল ম্যানেজ’ করে এরা যেভাবে-যখন দাম বাড়াতে চায়, বাড়ায়। অল্পদিনেই হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নেয়। বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এমনকি নিজেরা ফায়দা লুটে বসে বসে মজা দেখেন- বলেও জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

কাওরান বাজারের পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ চিকন চালেরই যোগান আসে কুষ্টিয়া, চাঁপাই, নওগাঁ ও আশুগঞ্জ এলাকা থেকে। মোটা চাল আসে বগুড়ার শেরপুর থেকে। এসব এলাকার কয়েকজন মিল মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে রাইজিংবিডির। তারা জানিয়েছেন, দেশের অনেক জমিতেই বছরে তিন বার চাষাবাদ হয় না। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব, সেচ ব্যবস্থায় সমস্যা, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টিতে ফসলহানী এবং সময়মত ফসলের জমিতে কাজ করার শ্রমিক সঙ্কটের কারণে চালের বাজারে এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে।

চাঁপাই হক অটো রাইস মিলের ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিতে প্রতিবছর ফসলহানী হচ্ছে। কৃষকদের কাছ থেকে আমরা সরাসরি যতটা ধান কিনতে পারছি; তার চেয়ে বেশি ধান ফড়িয়াদের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানি কিনে নিচ্ছে। ওদের টাকার তুলনায় আমাদের পরিমাণ কম বলে ওরা বেশি দামে ধান কিনছে। আবার সেই ধান থেকে চাল করে নিজেদের মতো করে বাজারে বিক্রি করছে।

চাঁপাইয়ের সাগর অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী সাগর বলেন, সাম্প্রতিক বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে আমাদের কয়েক শ’ টন ধান ও চাল ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে চাতালে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না আজকাল। বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার পানির কারণে এসব শ্রমিকদের বেশি মজুরি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধান কাটতে। তাই চাহিদামত চাল মিল থেকে সরবরাহ করতে পারছি না আমরা। ফলে বাজারে চালের দাম বেড়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের এম বি রাইস মিলের মালিক মোবারক চেয়ারম্যান বলেন, বড় বড় কোম্পানিরা কৃষকদের উৎপাদিত ধানের একটা বড় অংশ কিনে নিয়ে যান। ওরা যে টাকায় কিনে নেয়, আমরা সেই টাকায় কিনতে পারি না। পরবর্তী সময়ে তারাই নিজেদের মনমতো দামে বাজারে চাল বিক্রি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

‘অনেকে নিজের জমি এখন আর চাষ করেন না। বর্গা দেওয়ার লোকও এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। যাদের পরিবারের লোকজন বিদেশে কাজ করছেন। তাদের পাঠানো টাকাতে দেশে পরিবারগুলো দিন কাটাচ্ছে। তারা এখন আর কষ্ট করে চাষাবাদ করছে না। এদেরকে বাধ্যতামূলক নিজের জমি চাষ করাতে হবে। অন্যথায় সেই জমি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে সরকারিভাবে বছরে তিনটা ফসলের চাষ করাতে হবে’- এমনটাই জানান সিটি রাইস মিলের বেলায়েত হোসেন।

পাশাপাশি তিনি বলেন, সরকার যেভাবে ন্যায্যমূল্যে সার বা বীজ দিচ্ছে- সেভাবে সেচের জন্য, ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্যও সহজ কিস্তিতে এবং অল্প দামে কৃষকদের মেশিন সরবরাহ করলে তারা নিজেদের জমিতে চাষাবাদে উৎসাহী হবেন। সরাসরি সরকারিভাবে ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পান। কোম্পানিরা যাতে ইচ্ছেমত দামে ধান কিনতে না পারেন- সেজন্য একটা সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ ও কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে।

এদিকে বাজার ঘুরে, চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে আরেকটি তথ্য জানা গেছে, গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাজারে চাহিদামত নাজিরশাইল চালের সরবরাহ নেই। যার কারণে এক কেজি নাজির ৭০ থেকে এখন ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগের ৪২ টাকার পাইজাম আজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৬ টাকা। ৫২ টাকা কেজির আটাশ চালের আজকের দাম ৫৬ টাকা। মিনিকেট চাল ৬০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকায়।

কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং না করলে, বন্যা পরিস্থিতি বা লাগাতার বৃষ্টি হলে- চালের দাম সামনে দিনগুলোতে আরো বাড়তে পারে বলেও জানালেন মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা।

 

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়