ঢাকা     বুধবার   ০১ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

করোনার ধাক্কা সামলে সফল ‘কূটনীতির বছর’

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ২২ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১০:২৯, ২২ ডিসেম্বর ২০২২
করোনার ধাক্কা সামলে সফল ‘কূটনীতির বছর’

মহামারি করোনার ধাক্কা সামলে বিদেশে নতুন করে জনশক্তি রপ্তানি, অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করা এবং গত কয়েক বছরের মতো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান নিয়ে কেটেছে ২০২২ সাল। এর মধ্যে জনশক্তি রপ্তানির জন্য নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি, টিকা কূটনীতি প্রভৃতিতে সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি, চলতি বছরকে সরকারের পক্ষ থেকেও সফল একটি ‘কূটনীতির বছর’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, বিশেষ করে ইউরোপীয় অঞ্চলে জোর তৎপরতা; করোনা পরবর্তী শ্রমবাজার সৃষ্টি, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য, ব্রুনাইসহ কয়েকটি দেশের সাথে বেশকিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর, বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা; বেশ কয়েক জন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতার বাংলাদেশ সফর, বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন; ঢাকায় সফল ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোটের (আইওআরএ) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন ইত্যাদিকে চলতি বছরের গুরুত্ব অর্জন হিসেবে ধরা হচ্ছে। এ ছাড়াও বেশকিছু ইস্যুতে চলতি বছর সরকারের অভাবনীয় সাফল্য ছিল।

তবে, অর্জনের পাশাপাশি চলতি বছরে কূটনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনারও জন্ম দিয়েছে বেশকিছু বিষয়। এর মধ্যে অন্যতম হিসেবে আলোচনায় ছিল বারবার ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশি কূটনীতিকদের কোড অব কনডাক্ট (আচরণবিধি ও শিষ্টাচার) ভঙ্গের অভিযোগ। এ ছাড়া মিয়ানমারের সাথে অমীমাংসিত সীমান্ত পরিস্থিতি, জাপান সফরের ঘোষণা দিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সফর পেছানো, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুয়েকজন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য ইত্যাদি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে চলতি বছরেও সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনও অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র তাদের শরণার্থী আশ্রয়ের অংশ হিসেবে ২২ জন রোহিঙ্গাকে নেওয়ার মাধ্যমে ছোট পরিসরে এই কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। এটি কিছুটা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে শেষ হয়ে বিএনপির এক অপহৃত নেতার বাসায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যাওয়াকে কেন্দ্র করে সরকারের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সাফল্য
জাতির পিতার সফল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও সরকারের অর্থনৈতিক কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। এর মধ্যে রয়েছে নতুন নতুন রপ্তানি বাজার সৃষ্টি এবং জনশক্তি রপ্তানি।

করোনা পরিস্থিতিতে এলোমেলো হয়ে যায় বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। করোনার ধাক্কা কিছুটা সামলে বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজার নিয়ে কূটনৈতিক সাফল্য ছিল চলতি বছর। ২০২২ সালে কয়েকটি দেশের সাথে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়, কিছু দেশের সুযোগ আরও বাড়ানো হয়। অনেক বছর বন্ধ থাকার পর চলতি বছর মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি আবার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশি কর্মী চলতি বছরে যাওয়া শুরু করেছে রোমানিয়ায়। এ ছাড়া চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের কোটা দ্বিগুণ করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। এর ফলে ২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাড়ে সাত হাজার কর্মী যাবে। এটি একটি সুসংবাদ।

দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত লি জাং-কেউন জানান, ২০২৩ সালের শুরু থেকে সপ্তাহে ১৫০ জন করে, বছরে ৭ হাজার ৫০০ বাংলাদেশির দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ আসছে।

চলতি বছর ঢাকা সফরে আসেন পর্তুগালের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ফ্রান্সিসকো আনদ্রে। তার সফরে পর্তুগালে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। তিনি জানিয়েছিলেন, কনস্যুলেট অফিস খুলে ঢাকা থেকে পর্তুগালগামীদের ভিসা দেবে লিসবন। আরও বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী নেওয়ার পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতেও রাজি হয়েছে দেশটি।

এ ছাড়া ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়াসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের সাথে বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

আলোচনায় নির্বাচন ও রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য রেখে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির একটি মন্তব্য জোর আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাপান, যুক্তরাজ্য আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার আহ্বান জানান। 

সফর ও চুক্তি
বছরের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর। গত বছরের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করেন। ফিরতি সফর হিসেবে প্রায় তিন বছর পর শেখ হাসিনা ভারত সফরে যান চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে। দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতার প্রশ্নে আলোচনার পর সফরে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। সফরের বাগেরহাটের রামপালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিটের উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। একই অনুষ্ঠানে উদ্বোধন করা হয় রূপসা রেল সেতুও। এ ছাড়া আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে একমত হয়েছে দু’দেশ। 

তবে ঘোষণা দিয়েও শেষ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর স্থগিত হওয়ায় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম ধনী দ্বীপরাষ্ট্র ব্রুনাই দারুস সালামের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদ্দৌলাহ চলতি বছর প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে আসেন। সফরে বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের মধ্যে একটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।

দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তার সফরে চীন ও বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সাংস্কৃতিক বিনিময় (নবায়ন) এবং সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিষয়ক সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে একমত হয়। এ ছাড়া উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে চীন আরও ১ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সে কারণে এখন থেকে চীনের বাজারে ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পোশাক-শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পপণ্য রয়েছে।

আগস্টে পাঁচ দিনের সফরে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাচলেট। তার এই সফর দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে বলে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সদর দপ্তর এক বার্তায় জানায়।

চলতি বছরের নভেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে অংশীদারত্ব সহযোগিতা চুক্তি (পার্টনারশিপ কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট-পিসিএ) সই করতে সম্মত হয় উভয় পক্ষ।
নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং রোড টু মক্কা সার্ভিস নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। আশা করা হচ্ছে, এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে সুসংহত করবে। নভেম্বরে সৌদি উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর নাসের বিন আব্দুল আজিজ আল দাউদের ঢাকা সফরে চুক্তিগুলো হয়। 

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়