ঢাকা     মঙ্গলবার   ২২ অক্টোবর ২০২৪ ||  কার্তিক ৬ ১৪৩১

‘প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা বিধিমালা মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ১৩ জুন ২০২৪  
‘প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা বিধিমালা মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার’

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা বিধিমালা-২০২৪ মতপ্রকাশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার বলে অভিযোগ করেছে আর্টিকেল নাইনটিন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা মূল আইন‌টি সংশোধ‌ন কর‌তে সরকা‌রের প্রতি আহ্বান জা‌নি‌য়ে‌ছে।

বৃহস্প‌তিবার টিআইবির ধানমণ্ডিস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানা‌নো হ‌য়। ‘প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা বিধিমালা, ২০২৪: পর্যালোচনা ও সুপারিশ’ প্রকাশ উপলক্ষে আর্টিকেল নাইনটিন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যৌথভাবে এ সংবাদ স‌ম্মেল‌নের আ‌য়োজন ক‌রেছে।

সংবাদ সম্মেলনে পর্যালোচনা ও সুপারিশপত্রটি উপস্থাপন করেন এর প্রণয়নকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন। এসময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান; উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও আর্টিকেল নাইনটিন-এর আঞ্চলিক পরিচালক (বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া) শেখ মনজুর-ই-আলম। 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অংশীজনদের তীব্র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নিবর্তনমূলক ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’-এ মতপ্রকাশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণমূলক ধারা অপরিবর্তিত রেখে সংশ্লিষ্ট আইনের বিধিমালা প্রণয়ন ফলপ্রসূ হবে না। তাই ‘সাইবার নিরাপত্তা বিধিমালা, ২০২৪’ চূড়ান্ত করার আগে অর্থপূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও সব অংশীজনের উদ্বেগ, মতামত ও পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে।

বিধিমালাটি প্রণয়নের আগে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে, এমন প্রতিফলন খসড়ায় দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনটি মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরই পরিবর্তিত মোড়ক এবং সমভাবে নিবর্তনমূলক। তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমে তথ্য ও মত-প্রকাশের যে অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবেই ডিএসএর অবিকল সিএসএ প্রনীত হয়েছে। ইতোমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনায় যেসব নিবর্তনমূলক উপাদান উঠে এসেছে, প্রস্তাবিত বিধিমালাটির ক্ষেত্রে তা আরো জটিলতর হয়েছে। তাই বিধিমালা প্রণয়নের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার আগে অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে মূল আইনটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিসহ সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে তাদের মতামত ও পরামর্শ অনুযায়ী আইনটি সংশোধন করা অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি। অন্যদিকে যে সাইবার নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে, সেটিকে একদিকে অত্যন্ত বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে জনবলসহ প্রাতিষ্ঠানিক পরিচালন কাঠামো অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। তাছাড়া, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দেশে এবং দেশের বাইরের সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠানকে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে, তাদের কোনো উপস্থিতিই এই বিধিমালায় রাখা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সার্বিকভাবে মূল আইন এবং বিধিমালার যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে, এমন কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না, শুধুমাত্র অধিকার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবেই এটি ব্যবহৃত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।’

আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, ‘আইন প্রণয়নে আমরা অনেক তাড়াহুড়ো করি। একের পর এক আইন করেই যাচ্ছি এবং কোনোটাই চূড়ান্ত হচ্ছে না। দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিশেষ কোনো গুণগত পরিবর্তন ছাড়াই সরকার নামকরণে ডিজিটাল এর পরিবর্তে সাইবার শব্দটি ব্যবহার করে সাইবার নিরাপত্তা আইনটি করেছে। সেক্ষেত্রে একটি ভ্রান্ত আইনের ওপর নির্ভর করে এই বিধিমালা প্রণয়ন খুব একটা কাজে আসবে না। আমরা ডেটা প্রটেকশনের আইন করতে পারিনি কিন্তু এআই পলিসি নিয়ে কাজ করছি। অথচ এআই-এর কাজ মূলত ডেটা নির্ভর। আগে আসলে নিশ্চিত হতে হবে, আমরা কী করতে চাই। সাইবার স্পেসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবর্তে আমরা জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ, তথ্য উপাত্তে প্রবেশ এবং তার মাধ্যমে মানুষকে হেনস্থা করার উদ্দেশ্যে এ জাতীয় আইন প্রণয়নে আগ্রহ দেখাচ্ছি-এমন অবস্থান থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।’

সাইবার নিরাপত্তা আইন ও প্রস্তাবিত বিধিমালাটি অধিকতর অধিকারভিত্তিক, মতপ্রকাশ, গণতন্ত্র-সহায়ক ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিতের অন্যতম সহায়ক অনুষঙ্গে পরিণত করতে আর্টিকেল নাইনটিন ও টিআইবি বেশ কিছু সুপারিশ ক‌রে‌ছে। এগুলো মধ্যে রয়েছে-সাইবার নিরাপত্তা বিধিমালা, ২০২৪ চূড়ান্ত করার আগে কার্যকর অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ ঢেলে সাজাতে হবে। বিধিমালাটি সীমিত অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও মানব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ন্যূনতম ব্যক্তিগত, শিক্ষাগত ও প্রযুক্তিগত যোগ্যতা সুনির্দিষ্টকরণ; দেশের ভেতর ও বাহির থেকে ডিজিটাল সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বিধিমালায় আইনি কার্যবিধি অন্তর্ভুক্ত করা; জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির একটি কার্যকর ও অর্থপূর্ণ সাংগঠনিক-কাঠামো থাকতে হবে। এছাড়া নতুন ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা না করে বর্তমান ফরেনসিক ল্যাবটিকে আধুনিক যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার ও লোকবল দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপযুক্ত সময়ে নতুন ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা যেতে পারে; জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি, জাতীয় সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম ও ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রমে যাতে নাগরিকদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন না হয়, সে সংক্রান্ত সুরক্ষা বিধান প্রস্তাবিত বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

 

নঈমুদ্দীন/শাহেদ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়