রূপান্তরের ডাকে ডুবল বছরের শেষ সূর্য, স্বাগতম ২০২৬
২০২৫ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর আলোড়ন ও নাটকীয়তার বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। নির্বাচন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতা, নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, সহিংসতা, বিচার, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং বছরের শেষপ্রান্তে এসে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু— সব মিলে বছরটি ছিল ঘটনাবহুল ও সংকটময়। শীতের দাপট থাকলেও রাজনীতির প্রখরতার কাছে তা রইল ম্লান; রাজনীতির উত্তাপ নিয়ে রূপান্তরের আহ্বানে রেখে ডুবল বাংলাদেশের আকাশের শেষ সূর্য।
এই বছরে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ক্ষমতার রূপান্তর-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, বিচার ও সংস্কারের প্রশ্ন, নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা এবং রাজপথের সহিংসতা। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং খালেদা জিয়ার মৃত্যু।
জীবনাবসানেও অনিঃশেষ খালেদা জিয়া
বছর শেষ হওয়ার ঠিক আগের দিন, ৩০ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হৃদরোগ এবং সর্বশেষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪০ দিন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মৃত্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও এক দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এই শোক নিয়ে নতুন বছর ২০২৬ সালে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে শোককে শক্তিকে পরিণত করে গণতান্ত্রিক পথে দেশের যাত্রা বেগবান করার অঙ্গীকার বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর সময় তার পাশে ছিলেন তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান, নাতনি জাইমা রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা। একজন রাষ্ট্রনায়কের বিদায় হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ দেয়। স্মরণকালের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার জানাজাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে।
তার মৃত্যু শুধু বিএনপির জন্য নয়, বরং দেশের রাজনীতির একটি যুগের অবসান হিসেবেও বিবেচিত হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শেষপর্যন্ত সর্বজনের শ্রদ্ধায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বামী জিয়াউর রহমানের সমাধির পাশে অনন্ত যাত্রায় শায়িত হয়েছে তিনি।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়, ইতিহাসের নজিরবিহীন অধ্যায়
২০২৫ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অনুপস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন।
এই রায়কে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত শহীদদের আত্মদানের বিচার হিসেবে দেখা হয়। জুলাইয়ের পক্ষের শক্তি রায়কে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করে।
তবে এই রায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রায়ের বিচারিক প্রক্রিয়া ও মৃত্যুদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়।
রায়ের পর নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ লকডাউন ও শাটডাউনের মতো নিস্ফল কর্মসূচি ঘোষণা করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। তবে তা শক্ত হাতে দমন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
নির্বাচন ও তফসিল: অনিশ্চয়তার অবসান
সারা বছরজুড়েই নির্বাচন হবে কি না— এই প্রশ্ন রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ঘোষণা করেন, ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটে, যদিও রাজনৈতিক উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি।
শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড: রাজনীতিতে সহিংসতার ভয়াবহতা
নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পরদিনই ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করার ঘটনা দেশকে নাড়িয়ে দেয়।
মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হলেও এক সপ্তাহ পর সিঙ্গাপুরে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর ঢাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় এবং প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এই হত্যাকাণ্ড রাজনীতিতে সহিংসতার নতুন মাত্রা যোগ করে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন: রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ
১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ২৫ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সপরিবারে দেশে ফেরেন। তার আগমনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় নজিরবিহীন জনসমাগম হয়।
পূর্বাচল ৩০০ ফিটে দেওয়া বক্তব্যে তিনি দেশের জন্য তার একটি ‘পরিকল্পনার’ আছে বলে তুলে করেন এবং নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান। তার প্রত্যাবর্তন বিএনপির রাজনীতিতে নতুন গতি এনে দেয় এবং নির্বাচনি রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি: নতুন শক্তির উত্থান
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের হাত ধরে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। নাহিদ ইসলাম দলের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেন।
গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন, যা নতুন রাজনৈতিক শক্তির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।
ধানমন্ডি ৩২ ভাঙচুর
ফেব্রুয়ারি মাসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা রাজনৈতিক প্রতীক ও ইতিহাস নিয়ে বিতর্ককে নতুন করে উসকে দেয়।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রশ্ন
জুলাই মাসে উত্তরায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৩৬ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই শিশু। অক্টোবরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দেয়।
২০২৫ সাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিল পরিবর্তন, সংঘাত ও পুনর্গঠনের বছর। খালেদা জিয়ার মৃত্যু, শেখ হাসিনার রায়, নির্বাচন ঘোষণাসহ প্রতিটি ঘটনা রাজনীতিকে নতুন মোড়ে দাঁড় করিয়েছে। এই ঘটনাবহুল বছর ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলবে- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে যায় খালেদা জিয়ার মৃত্যুর ঘটনা। এটি একদিকে যেমন গভীর শোকের, অন্যদিকে তেমনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভিযাত্রায় নতুন সূর্য ওঠার অঙ্গীকার। জীবনজুড়ে মাটি-মানুষ ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে পারলৌকিক অশেষ পথে খালেদা জিয়ার যাত্রাকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রায় শপথস্বরূপ দেখছে দেশের মানুষ।
স্বাগতম ২০২৬
খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২৬ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন, যার প্রক্রিয়া চলমান। এই আয়োজন সফল করতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণের শেষপর্যায়ে রয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর দেশে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হবে বলে সরকার আশা করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের েইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হবে। এই গণভোটে দেশের প্রয়োজনীয় প্রস্তাবিত সংস্কার উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ হবে। ফলে কী ধরনের সংস্কার নিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এই গণভোটের ওপর।
যদি নির্বাচন ও গণভোট গণতান্ত্রিক উপায়ে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়, তাহলে ২০২৬ সালে দেশের স্থবির অর্থনীতির চাকা সচল হবে আশা করা হচ্ছে। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বয়ে আনবে বিদেশি বিনিয়োগও। তবে নতুন বছরটি রাজনৈতিকভাবে কতটা স্থিতিশীল থাকবে, তা গণনা করে এখনই বলে দেওয়া সম্ভব নয়।
ঢাকা/রাসেল