ঢাকা     বুধবার   ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

২০২৫ সালে ইবি: প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির সমীকরণ

ইবি প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৪, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫  
২০২৫ সালে ইবি: প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির সমীকরণ

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলে আরো একটি বছর। রাত পোহালেই শুরু হবে নতুন বছর ২০২৬; নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার আহ্বানে। তবে নতুন বছরের পথে এগিয়ে যাওয়ার আগে ফিরে তাকাতে হয় পেছনের দিকে; যেখানে রয়ে যায় অর্জন, সংকট, বেদনা আর পরিবর্তনের স্মৃতি।

২০২৫ সালজুড়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ছিল খবরের শিরোনামে। শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা বহিষ্কার, শিক্ষার্থী সাজিদ হত্যাকাণ্ড, একের পর এক মৃত্যু, নতুন অনুষদ ও বিভাগ চালু, সেবা খাতে পরিবর্তন, ইকসু গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন; সব মিলিয়ে বছরটি ছিল ঘটনাবহুল ও বহুমাত্রিক।

আরো পড়ুন:

বহিষ্কার ও শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তে আলোচিত প্রশাসন

২০২৫ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় একাধিক কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও সমকামিতাসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাফিজুল ইসলামকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। ৩১ মে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ২৬৮তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী দক্ষতা ও শৃঙ্খলা বিধির আওতায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

একইভাবে অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলামকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে অনুপস্থিত থাকা এবং নির্দেশনা অমান্যের অভিযোগ তদন্ত শেষে ২৭০তম সিন্ডিকেট সভায় তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পোস্ট-ডক্টোরাল গবেষণা ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগদান না করায় ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. বিকাশ চন্দ্র সিংহকেও চাকরিচ্যুত করা হয়।

সবচেয়ে আলোচিত সিদ্ধান্ত আসে জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিরোধী তালিকাকে কেন্দ্র করে। এ তালিকায় থাকা ১৯ জন শিক্ষক, ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ৩৩ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বরখাস্ত, বহিষ্কার ও সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই ঘটনায় সাংবাদিকদের মারধরের অভিযোগে তিন শিক্ষার্থীকে দুই সেমিস্টারের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

এই সিদ্ধান্তগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসন ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে যেমন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, তেমনি ক্যাম্পাসে বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

শোকের ছায়া: সাজিদ হত্যাসহ অপূরণীয় ক্ষতি

২০২৫ সালের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থী সাজিদের মৃত্যু। ১৭ জুলাই শাহ আজিজুর রহমান হলের পুকুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে ভিসেরা রিপোর্টে শ্বাসরোধে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তবে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নিরাপদ ক্যাম্পাস ও সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

বছরজুড়ে আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে হারিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়; সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যানসার, কিডনি ও লিভার রোগ, স্ট্রোক এবং বার্ধক্যজনিত কারণে। শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম, সুমাইয়া শারমিন শান্তা, উত্তম কুমার রায়, আবুল কাশেম ও দেবতোষ সরকার দিব্যর মৃত্যু ক্যাম্পাসকে শোকাচ্ছন্ন করে তোলে।

এছাড়া, প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ইয়াহিয়া রহমান, সহকারী রেজিস্ট্রার ইশরাত জাহান লাবনী এবং কর্মকর্তা নেতা দেওয়ান টিপু সলতানের মৃত্যু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক অঙ্গনে অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে।

নতুন অনুষদ, বিভাগ ও শিক্ষক নিয়োগ

২০২৫ সালে একাডেমিক সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ‘ইসলামিক ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’ নামে নতুন অনুষদ চালুর সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। এর অধীনে তিনটি বিভাগ চালু হচ্ছে। পাশাপাশি থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের অধীনে আরও দুটি নতুন বিভাগ অনুমোদন দেওয়া হয়।

শিক্ষক সংকট নিরসনে ছয়টি বিভাগে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও এখনো অন্তত ১৪টি বিভাগ তীব্র সংকটে রয়েছে। কিছু বিভাগে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও সিন্ডিকেটের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

নামকরণ পরিবর্তন ও অবকাঠামোগত উদ্যোগ

২০২৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হল, ভবন ও বিভাগের নাম পরিবর্তন করা হয়। শেখ পরিবারের নামে থাকা বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে আলোচিত হয়। পাশাপাশি তিনটি বিভাগের নাম পরিবর্তন এবং ধর্মতত্ত্ব অনুষদ ভবনের পুরোনো নাম পুনর্বহাল করা হয়।

হলভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম, রিডিং রুম, জব কর্নার, স্মৃতি সংগ্রহশালা, পুকুরে মাছ অবমুক্তকরণসহ নানা অবকাঠামোগত উদ্যোগও বাস্তবায়ন করা হয়।

সেবা খাতে আধুনিকায়নের চেষ্টা

আবাসিক হলগুলোতে ইন্টারনেট, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, মেডিসিন কর্নার, লন্ড্রি ও পাঠাগার সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। যদিও এখনো প্রায় ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধার বাইরে, তবে নতুন চারটি হল নির্মাণাধীন রয়েছে।

ডিজিটাল পেমেন্ট চালুর উদ্যোগ, বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি এবং গ্রন্থাগারের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবা ব্যবস্থাকে আধুনিক করার পথে এগিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংযোগ ও গবেষণায় অগ্রগতি

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের মাধ্যমে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হলেও এর অনেকগুলো এখনো কার্যকর রূপ পায়নি। তবে ইউজিসির অর্থায়নে ১৪১ জন গবেষক নির্বাচিত হওয়া এবং দুই শিক্ষক বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পাওয়া গবেষণায় ইতিবাচক অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়।

ইকসু গঠনতন্ত্র: দীর্ঘ অপেক্ষার পথে এক ধাপ

২০২৫ সালে আলোচনায় আসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ইকসু)। আন্দোলন, আলোচনা ও কমিটি গঠনের পর অবশেষে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র সিন্ডিকেটে পাস হয়। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে এটি অর্ডিন্যান্স আকারে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন সংযোজন

পরিবেশবান্ধব চারটি বৈদ্যুতিক শাটল কার এবং চারটি ডাবল ডেকার বাস সংযোজনের মাধ্যমে ক্যাম্পাস পরিবহন ব্যবস্থায় কিছুটা স্বস্তি ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

উপসংহারে

সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছিল সংকট, শোক ও সংস্কারের বছর। প্রশাসনিক কঠোরতা, শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ড ও একের পর এক মৃত্যু যেমন ক্যাম্পাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি নতুন অনুষদ, সেবা খাতের উন্নয়ন ও ইকসু গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথাও বলছে।

ঢাকা/তানভীর/জান্নাত

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়