চোখ খুলে দিলেন জাসিন্ডা আরডার্ন
জাসিন্ডা আরডার্ন (ছবি : ইন্টারনেট)
সাইফ বরকতুল্লাহ : কিশোরগঞ্জের তরুণী সাজেদা আক্তার লিপি। দুই বছর আগে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে লিপিকে নিউজিল্যান্ডে নিজের কাছে নিয়ে যান মাসুদ মিয়া। অনেক স্বপ্ন তাদের। কিন্তু হঠাৎ এমন সুখের স্বপ্নে যেন দীর্ঘশ্বাস। ঘটনাটি গত ১৫ মার্চের। জুম্মার নামাজ আদায় করতে একই গাড়িতে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে যান মাসুদ ও লিপি। বন্দুক হামলার সময় অলৌকিকভাবে রক্ষা পান মাসুদ মিয়া। তবে ঘাতকের বুলেটে বিদ্ধ হন ২৫ বছর বয়সী লিপি। বন্দুক হামলায় আহতদের মধ্যে সবচেয়ে সংকটজনক অবস্থায় ছিলেন তিনি। ঘটনার ৮দিন পর ২৩ মার্চ চোখ মেলে তাকিয়েছেন। লিপি ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালের আইসিইউতে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাকে লাইফ সাপোর্টেও রাখা হয়েছিল। চিকিৎসকদের বরাতে লিপির স্বজনরা জানিয়েছেন, এখনো শঙ্কামুক্ত নন লিপি। তবে তাদের আশা লিপি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠবেন। নিউজিল্যান্ডে অবস্থানরত লিপির স্বামী মাসুদ মিয়া গণমাধ্যমকে জানান, দিন দিন তার স্ত্রী ভালোর দিকে যাচ্ছে। আল্লাহ যেন তাকে বাঁচিয়ে রাখেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নও হাসপাতালে গিয়ে তার খোঁজ নেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা লিপির চোখ খোলার খবরে স্বজনদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
দুই.
লিপির মতো হতাহতদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে মানবতার এক অসাধারণ উদাহরণ হয়ে রইলেন জাসিন্ডা আরডার্ন। বিশেষভাবে বলা যায় ক্রাইস্টচার্চে হামলার পর থেকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন বিশ্ব নেতাদের চোখ খুলে দিয়েছে। হামলার পর থেকে আপডেট খবর প্রধানমন্ত্রী হয়েও নিজে গণমাধ্যমে ব্রিফ করেছেন। তাকে সব সময় ভারাক্রান্ত দেখা গেছে টেলিভিশনের পর্দায়। ঘটনার জন্য বারবার দুঃখ প্রকাশ করেই থেমে যাননি, বলা যায় ঘটনা পরবর্তী সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে তাকে। তার এসব কাজের উধ্বৃতি দিয়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘জাসিন্ডা আরডার্ন এর মতো ভালো নেতা প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। আতঙ্ক কীভাবে সামাল দিতে হয়, তা তার কাছ থেকে বিশ্বের শেখা উচিত। নিউজিল্যান্ডে একটি হত্যাযজ্ঞ সরকারকে সজাগ করতে পারল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ হলেও কিছুই হয় না। সংকটের সময় নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিত, তা শিখিয়েছেন জাসিন্ডা আরডার্ন।
তিন.
জাসিন্ডা আরডার্ন এর জন্ম ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই। ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের ৪০ তম প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। সে সময় তাকে ঘিরে ব্যাপক উন্মাদনা তৈরি হয় যার নামকরণ করা হয় জাসিন্ডাম্যানিয়া। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্রাইস্টচার্চে হামলার মতো ঘটনা তাকে সামলাতে হয়নি। আর হবেই বা কেন, দেশটি যে বিশ্বের শান্তিকামী দেশের মধ্যে অন্যতম। বিশ্ববাসীও কল্পনা করেনি এই দেশে এরকম নৃশংস হত্যাযজ্ঞ হবে। কিন্তু সে জায়গাটাই রক্তাক্ত হলো। বিশ্ববাসী দেখলো শান্ত এক শুক্রবারে কালো অন্ধকার। এই অন্ধকার কেবল নিউজিল্যান্ডকে ভারাক্রান্ত করেনি, বিশ্বজুড়ে মানুষকে আলোড়িত করেছে। তবে এই ঘটনার পর জাসিন্ডা আরডার্ন বিশ্ব নেতাদের নতুন এক পথ দেখিয়েছেন। গত ২২ মার্চ আল নুর মসজিদের সামনে হেগলি পার্কে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। সে সময় তার মাথা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা ছিল। তিনি বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে পুরো নিউজিল্যান্ডই ব্যথিত।’ ইসলামের বাণী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাসী পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে একটি শরীরের মতো থাকবেন। যখন শরীরের কোনো অঙ্গে ব্যথা হয় তখন পুরো শরীরে ব্যথা হয়।’
চার.
এত কম বয়সে তার যে দৃঢ়চেতা, তা সত্যিই ‘দ্য লিডার’-এ পরিণত করেছে তাকে। বিশ্ব মিডিয়া থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে তার ব্যাপক প্রশংসা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে সুজানে মুর লিখেছেন, ‘মার্টিন লুথার কিং বলেছেন সত্যিকারের নেতারা ঐক্য খোঁজে না তারা ঐক্য তৈরি করে, আরডার্ন ভিন্ন ধরনের ঐক্য তৈরি, কর্ম, অভিভাবকত্ব ও একতা প্রদর্শন করেছেন। সন্ত্রাসবাদ মানুষের মাঝে ভিন্নতাকে দেখে এবং বিনাশ ঘটায়। আরডার্ন ভিন্নতা দেখেছেন এবং তাকে সম্মান করতে চাইছেন, তাকে আলিঙ্গন করছেন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন।’
ঘটনার প্রথমদিনই জাসিন্ডা আরডার্ন তার বক্তব্যে বলেন, ‘যারা মারা গেছেন, তারা হয়তো ইমিগ্রেন্ট ছিলেন, অন্য দেশ থেকে এসেছিলেন। তারা সবকিছু ফেলে নিউজিল্যান্ডকেই আপন করে নিতে চেয়েছিলেন। এই দেশটাকে নিরাপদ ভেবেছিলেন। সেই নিরাপত্তাটা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।’
সবশেষ গত শুক্রবার দুই মিনিটের জন্য নীরব ছিল পুরো নিউজিল্যান্ড। এর আগে দেশটির জাতীয় রেডিও-টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয় জুমার আজান। সহমর্মিতার বার্তা নিয়ে শুক্রবার কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছিল ক্রাইস্টচার্চের আল-নূর মসজিদের সামনে। নীরবতা পালনের পর সংক্ষিপ্ত ভাষণে সন্ত্রাসী হামলায় আল-নূর মসজিদে নিহতদের স্বজনদের সান্তনা দিতে গিয়ে জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, ‘আপনাদের সঙ্গে কাঁদছে নিউজিল্যান্ড। আমরা সবাই এক।’
পাঁচ.
সত্যিই অসাধারণ এক কাজ করে গেলেন জাসিন্ডা আরডার্ন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলা হয় কিন্তু এরকম ঘটনা কেউ সঠিকভাবে সামলে নিতে পারেনি। যেমনটি জাসিন্ডা আরডার্ন করলেন। এখন হয়তো বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ঢেউ বইবে। কিন্তু জাসিন্ডা আরডার্ন এই ঢেউয়ে নতুন বার্তা দিয়ে রাখলেন।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মার্চ ২০১৯/সাইফ/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম