ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আদালতের রায় ও রাষ্ট্র মনস্তত্ত্ব

মারুফ রসূল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
আদালতের রায় ও রাষ্ট্র মনস্তত্ত্ব

চলতি মাসেই বাংলাদেশের আদালত থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ রায় আমরা পেয়েছি। জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে গত ১০ ফেব্রুয়ারি এবং এর ঠিক ৬ দিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড মামলার রায় দিয়েছেন আদালত।

দুটো রায়ই ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক জনাব মজিবুর রহমান। দীপন হত্যা মামলার রায়ে আট আসামির সবাইকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই আট আসামি হলো— সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুর সবুর সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার ও শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের। এই আসামিদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক। বাকিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে। এরা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’-এর সদস্য।

অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় পাঁচ জঙ্গিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং জঙ্গি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে চারজন (জিয়া, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব এবং আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব) দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। দুটো রায়ের ক্ষেত্রেই আদালতের পর্যবেক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। দীপন হত্যা মামলার ৫৩ পৃষ্ঠা রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক হত্যার উদ্দেশ্য উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, লেখক-ব্লগার-প্রকাশকদের হত্যার অংশ হিসেবে অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্যই জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়। পর্যবেক্ষণের আরেকটি অংশে বিচারক জানিয়েছেন: ‘যারা বই প্রকাশের দায়ে মানুষ হত্যা করতে পারে, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু’।

প্রায় একই ধরনের বক্তব্য আমরা পাই অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার পর্যবেক্ষণে। সেখানে হত্যার উদ্দেশ্য হিসেবে বিচারক মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করার কথা উল্লেখ করেছেন। পর্যবেক্ষণে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন: ‘স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়’। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর মাধ্যমে হত্যাকারী উগ্র মৌলবাদীরা যে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ ও নিরুৎসাহিত করার ষড়যন্ত্র করেছিল, সেটা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে আদালত।

আদালতের এই পর্যবেক্ষণগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণগুলো কি কেবলই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে? যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচারিক রায় এবং সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে রায়গুলো কার্যকর করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজে বিচারিক রায়ের একটি প্রভাব থাকা জরুরি। অভিজিৎ রায়, ফয়সল আরেফিন দীপন, রাজীব হায়দার বা এ যাবৎকালে যতজন মুক্তচিন্তক লেখক-ব্লগার-প্রকাশক-গণমাধ্যমকর্মী হত্যা করা হয়েছে, তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এইসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে স্পষ্টভাবে কতগুলো অপ-আদর্শ কাজ করেছে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করা এবং সেই চিন্তার প্রকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে ধর্ম বা অন্যান্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ধুয়া তুলে নানা রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করাই এইসব হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য। মুক্তবুদ্ধিচর্চা আন্দোলন ও আদর্শকে দমনের জন্য এইসব উগ্র মৌলবাদী ও কূপমণ্ডুক অপ-দর্শনের ষড়যন্ত্রটি কেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বলয়েও বিরাজমান। এ কারণেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপরে রাষ্ট্রীয় খড়গ নেমে আসার ঘটনাগুলো আমাদের দেখতে হয়। উদারনৈতিক বাউল সংস্কৃতির ওপর মৌলবাদী হামলার ঘটনাগুলো আমরা ভুলে যাইনি। সুতরাং আমাদের স্পষ্টভাবে বোঝা প্রয়োজন আদালতের এই রায় বা রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কতখানি ক্রিয়াশীল হচ্ছে।

মুক্তচিন্তার প্রসারের ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায় বা অন্যান্য লেখক ও ব্লগারদের সৃষ্টিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। কিন্তু গত কয়েক বছরের বইমেলা বা পুস্তক প্রকাশনার দিকে যদি আমরা তাকাই, তবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের হতাশ হতে হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অভিজিৎ রায়ের কোনো বই পাওয়া যায় না। অনেকটাই যেনো নিষিদ্ধ। কোনো সরকারি নির্দেশনা না থাকলেও অভিজিৎ রায়ের বই কেনো তার প্রকাশকরা মেলায় রাখতে পারছেন না, তার ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। তার উপর আছে মেলায় পুলিশি সম্পাদনা। প্রতি বছর বইমেলা আসার আগে কী ধরনের বই প্রকাশ হবে বা হবে না, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ধরনের তৎপরতামূলক বক্তব্যগুলো আমরা দেখি, তাতে মনে হয়, বই সম্পাদনার পরোক্ষ দায়িত্ব যেনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। মাদ্রাসায় একের পর এক ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত বই সরকার গেজেট প্রকাশ করে নিষিদ্ধ করে। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই প্রশাসনের আপোসকামী মনোভাব জড়িত।

কেবল বইমেলা বা বই প্রকাশই নয়; সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রথম বাধাটি আসে প্রশাসনের কাছ থেকেই। প্রায় প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ক্ষেত্রে সরকারি বিধি-নিষেধ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। অথচ ওয়াজের নামে কিছু কাঠমোল্লা ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে হিংসাত্মক কথা ছড়াচ্ছে এবং নারীবিদ্বেষী কুৎসিত সব ফতোয়া জারি করছে। বিজ্ঞান সম্পর্কে উদ্ভট, বানোয়াট নানা ধরনের ভুল বক্তব্য প্রচার করছে এইসব কাঠমোল্লারা। এগুলো এখন ইউটিউব, ফেসবুকেও সমানে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশাসনের পদক্ষেপ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়। অন্যদিকে পূজা-পার্বণ বা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবগুলো সীমিত করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের তৎপরতা থাকে চোখে পড়ার মতো। গত কয়েক বছর ধরে আহমেদিয়া মুসলিম জামাতের বাৎসরিক জলসা উদযাপনের ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রশাসনিক বাধার সংবাদ আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, তা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন।

সুতরাং এই প্রশাসনের মনস্তত্ত্বটি এখন আলোচনায় আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে ধর্মীয় উন্মাদনার জিকির তুলে নানারকম ফায়দা হাসিল করেছে জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র মানে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রশাসনও। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এই অসাম্প্রদায়িকীকরণের উদ্যোগ আমরা দেখি না। মৌলবাদীদের এই অপকৌশল যদি এখনই রুখে দেওয়া না-যায়, তবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ আরও বেশি সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।

প্রশাসনের মনস্তত্ত্বে যে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে গেছে, তাকে পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিতে হবে। নাহলে মুক্তচিন্তক হত্যার রায় কার্যকর হলেও হত্যাকারীর সাম্প্রদায়িক ও হিংসাত্মক অপ-দর্শন থেকেই যাবে। সমাজকে এই অপ-দর্শন থেকেও মুক্ত করতে হবে।

লেখক ও ব্লগার

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়