ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফুটবল এবং বাংলাদেশের ফুটবল প্রসঙ্গে 

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ১২ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১১:৫৯, ১২ জুলাই ২০২১
ফুটবল এবং বাংলাদেশের ফুটবল প্রসঙ্গে 

এ লেখা যখন প্রকাশিত হবে তখন কোপা আমেরিকা এবং ইউরো-এর শিরোপা ঘরে তুলেছে যথাক্রমে আর্জেন্টিনা এবং ইতালি। তবে আসর দুটির পর্দা নেমে গেলেও ফুটবলপ্রেমী জাতি হিসেবে আমাদের আলোচনায় এর রেশ রয়ে যাবে। রাত জেগে ফুটবল উপভোগ করা, সমর্থক হিসেবে পরস্পরের বাকযুদ্ধ, এমনকি মারামারির মধ্য দিয়ে এসব উদযাপন আরও অর্থবহ হতো যদি দল হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্ব-ফুটবলে মর্যাদাপূর্ণ একটি অবস্থান থাকত।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রিকেটের উত্থানের সঙ্গে ফুটবল হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই এভাবে বলে থাকেন যে- ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার কারণেই ফুটবল পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে অবশ্য এটিকে অগ্রাহ্য করার অবকাশ নেই। ফুটবল না ক্রিকেট– কোন খেলায় উত্তেজনা বেশি এ নিয়ে ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ালে ফুটবলে সব মিলিয়ে সোয়া দুই ঘণ্টা সময় লাগে যার প্রতিটি মুহূর্ত উত্তেজনায় ভরপুর। সে বিবেচনায় ফুটবলই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা।

যদিও ক্রিকেটপ্রেমীরা এভাবে বলে থাকেন, ক্রিকেট খেলার কোনো একটি বল বা খেলার কোনো নির্দিষ্ট একটি সময় এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ যে তা ফুটবলের পুরো সময়ের উত্তেজনাকে ছাড়িয়ে যায়।

ফুটবলের জন্ম ইংল্যান্ডে (মতান্তরে চীন) হলেও এর রাজত্ব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনার বাইরেও অনেক শক্তিশালী দল রয়েছে। শুধু সাবেক যুগোস্লাভিয়ার কথা ভাবুন। ১৯৯১ সালে দেশটি নতুন যে ছয়টি দেশে বিভক্ত হয়েছে সেগুলো হলো – সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হারজেগোভিনা, নর্থ মেসিডোনিয়া ও স্লোভেনিয়া। এর মধ্য থেকে প্রতি বিশ্বকাপে ন্যূনতম দুটি দল প্রতিনিধিত্ব করছে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ফুটবলের সঙ্গে দেশের ভৌগলিক আয়তন ও জনসংখ্যার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকলে চীন, ভারত, রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ফুটবল দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করত। যদিও ১৯৫০ সালে ভারত ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছিল। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও বার্মা খেলতে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় ভারতের খেলার কথা হলেও শেষ পর্যন্ত আর খেলা হয়নি। কথিত আছে, সেবার থেকে বুট পরে খেলা বাধ্যতামূলক হওয়ায় এবং ভারতীয়রা সেভাবে অভ্যস্ত না-থাকায় অংশগ্রহণ করেনি।  

ফুটবলের সঙ্গে অর্থনীতির দারুণ সংযোগ রয়েছে। লা-লিগা, বুন্দেসলিগা, সিরি-এ কিংবা ইংল্যান্ডের একেকটি দলের যে সম্পদ আর রিটার্ন তা পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জিডিপির চেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার জিডিপি ৪ বিলিয়ন ডলারের অধিক যার বাৎসরিক টার্নওভার ৮৪০ মিলিয়ন ডলারের মতো। প্রায় একই অবস্থা রিয়েল মাদ্রিদ, ম্যানইউ, বায়ার্ন মিউনিখ, টটেনহ্যাম হটস্পার, ম্যান সিটির মতো দলগুলোর। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গেও এসব লিগের সম্পর্ক রয়েছে। একসময় ইতালিয়ান লিগের অনেক দাপট ছিল। ২০০০ সালের পর থেকে ইতালির অর্থনীতি খারাপের দিকে চলে যাওয়ায় লিগের গুরুত্ব কমে যায়। সকারনোমিক্স-এর হিসাব বলছে, কোনো দল বড় কোনো টুর্নামেন্ট জিতলে দেশের মোট জিডিপি ০.৫ থেকে ০.৮ শতাংশ হারে বাড়ে। পক্ষান্তরে, হারলে ৩ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।        

আমাদের ফুটবলের জৌলুস হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে গিয়েছে। ১৯৮০-৯০ এর দশকে আমাদের এশিয়ার একটি ভালো দল হিসেবে স্বীকৃতি ছিল। আর দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম সেরা দল তো ছিলামই। সময়ের পরিক্রমায় পার্শ্ববর্তী ভুটানের সঙ্গেও আমাদের হারতে হয়েছে। আমাদের ফুটবল যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারছে না তার কারণ বিশ্লেষণ করলে অনেক কিছুই উঠে আসবে। শারীরিক দুর্বলতা থেকে শুরু করে খেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনা- কী নেই এর মাঝে! একটি সংক্ষিপ্ত অথচ স্বয়ংসম্পূর্ণ আলোচনা করা যাক। 

প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদে আমাদের ফুটবল কোথায় যেতে চায় তার কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। মুখে মুখে বুলি আওড়ালে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। প্রয়োজন বয়সভিত্তিক ফুটবল ও পেশাদার লিগ। বয়সভিত্তিক যে আয়োজন রয়েছে তা আমাদের ফুটবলকে সামনে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট নয়। পেশাদার লিগ অনেকটা দায়সারাভাবে চলছে এবং এর মান নিচে নেমে গেছে। বিদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে এখন যারা আসছেন তাদের মান খুবই নিম্ন। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে অবৈধ কাজের সঙ্গে যুক্ত হতেও শোনা যায়। অথচ এক সময় আজামাত রহিমভ (যিনি পরে উজবেকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন) বা এমেকা ইজিউগো (যিনি ১৯৯৪ সালে নাইজেরিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছিলেন) আমাদের ঘরোয়া লিগ মাতিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, ফুটবলে জয়ের জন্য যে কৌশল দরকার তা আমরা প্রয়োগ করতে শিখিনি। এ কৌশল বাস্তবায়নে মাঠে অনেক কিছু করে দেখাতে হয়। এর একটি হলো ফরমেশন অনুযায়ী খেলা। এ ফরমেশন অনেক রকমের হতে পারে, ৪-২-৪, ৪-৪-২, ৪-৩-৩, ৫-৩-১, ৩-৪-৩, ইত্যাদি। ব্রাজিল ১৯৫০ এর দশকে অনেক আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলত; যেখানে ৪-২-৪ ফরমেশন প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। বর্তমানে ৪-৩-৩ বা ৪-৪-২ ফরমেশনের বহুল প্রয়োগ হলেও আধুনিক ফুটবলে কৌশল নির্ধারণ করা হয় প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা বিবেচনায়। কোপার ফাইনালে দি মারিয়াকে সেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। পুরা টুর্নামেন্টে বদলি হিসেবে খেলতে নামা ডি মারিয়া এদিন শুরু থেকে খেলেছেন। কারণ ব্রাজিলিয়ান লেফট ব্যাক রেনান লোদি যেভাবে বারবার উইং ধরে উঠে যান সেটিই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন আর্জেন্টাইন কোচ স্কালোনি। 

ইউরোপ কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার যে ফুটবল কৌশল তা অনেকটাই আলাদা। ইউরোপিয়ানরা লং পাসে গতিময় ফুটবল খেলতে ভালোবাসে। আর ল্যাটিন ফুটবলের সৌন্দর্য হচ্ছে ছোট ছোট পাস, অনেক বেশি বলের পজেশন। তবে কৌশল নির্ধারণে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে ২০১৪ সালে জার্মানির শিরোপা। যে দলের সঙ্গে যেভাবে খেলা দরকার সে কৌশল প্রয়োগ করে দলটি সেবার চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। কৌশলের বিষয় এলে আরও অনেক কিছু চলে আসে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের অফসাইড ট্র্যাপে ফেলাও কৌশলের অংশ।

তৃতীয়ত, ফুটবল খেলা একটি স্কিল। কারও খেলা সম্পর্কে অনেক জ্ঞান থাকতে পারে কিন্তু মাঠে করে দেখানোই আসল কাজ। খেলার মূল অংশ হলো বল রিসিভ, নিয়ন্ত্রণ, ড্রিবলিং ও পাসিং। পাসিং-এর ক্ষেত্রে আবার লম্বা ও ছোট পাস বিবেচনায় নিতে হয়। আমাদের ফুটবলারদের মাঝে এ চারটি স্কিলেরই ঘাটতি দেখা যায়। সাইড পরিবর্তন করে পাস দিয়ে খেলাকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া কিংবা উইং ধরে উঠে আক্রমণ করার মতো স্কিল আমরা রপ্ত করতে পারিনি। অন্তত বিগত সময়ে আমার নজরে আসেনি।

চতুর্থত, বলের পজেশন নেবার যে দক্ষতা আমাদের দরকার সেটি নেই। বলের পজেশন রক্ষা করতে হলে নিজেদের সীমানার বিপজ্জনক বল ক্লিয়ার করলেও তা নিজ দলের কাউকে দেবার স্কিল থাকতে হয়। অযথা থ্রো-ইন ও কর্ণার থেকে দলকে বাঁচাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ফুটবলে এরকম দেখিনি। বড় দলগুলো যে কোনো বিবেচনাতে বলের পজেশন হারাতে চায় না। হ্যান্ডবলে একটি বল হারানো মানে একটি গোল হজম করা। ফুটবলে এরকম না-হলেও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বলের পজেশন খেলার জয়-পরাজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পঞ্চমত, একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে ঘিরে খেলার কৌশল নির্ধারণের মতো কোনো খেলোয়াড় আমাদের নেই। পত্র-পত্রিকায় যতই ছবি ছাপা হোক আর টিভির বিজ্ঞাপনে দেখানো হোক সে রকম কেউ আমাদের নেই। আর্জেন্টিনার মেসি, পর্তুগালের রোনাল্ডো, ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদরিচের হিসাব বাদ দিলেও পার্শ্ববর্তী ভারতের বাইচুং ভুটিয়া কিংবা হাল আমলের সুনিল ছেত্রির মতোও কেউ নেই যাকে ঘিরে জয়ের নিশানা স্থির করা যায়।

ষষ্ঠত, ফুটবলের জন্য যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং কোচিং দরকার তা প্রয়োজন ও পরিকল্পনার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। স্থানীয় ও জাতীয় উভয় ক্ষেত্রেই মাঠ, খেলার সরঞ্জাম এবং কোনো কোচিং সহায়তা নেই। অনেকেই শুধু ব্যক্তিগত নৈপূণ্য দিয়ে একদম স্থানীয় পর্যায় থেকে উঠে আসছেন যা আসলে দেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রসঙ্গত, জনসংখ্যার বিপরীতে খেলার মাঠের অভাবে কার্যত আমাদের আগামী প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক গঠন বাধগ্রস্থ হচ্ছে।

সপ্তমত, আমাদের খেলোয়াড়দের শারীরিক গঠন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে মানানসই নয়। এখানে গঠন বলতে শুধু উচ্চতা বা শরীরের আকার বুঝানো হয়নি বরং ফুটবল খেলার জন্য যে শারীরিক সক্ষমতা দরকার সেটিও বলা হয়েছে। তবে এটিও মাথায় নিতে হবে, শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে মানসিক সক্ষমতাও সমান গুরুত্ব বহন করে। শুধু শরীর দিয়ে খেলা হলে আফ্রিকান দেশ ঘানা বা ক্যামেরুনই সব সময় কাপ ছিনিয়ে নিত। খেলার স্কিল অর্জনের মাথার ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হয়। ফুটবল শুধু পায়ের খেলা নয়; এখানে মাথারও সমান ব্যবহার রয়েছে।

বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ফুটবলকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়া একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে ফুটবল হতে পারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নতুন মাত্রা। ফিফা র্যাংকিং-এ ১৮৪ তে থাকা দেশটির ফুটবল সবার ভালোবাসায় এগিয়ে যাবে আর রাত জেগে নিজেদের খেলা দেখার সুযোগ সৃষ্টি হবে সে প্রত্যাশা করছি।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়