ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফকির আলমগীরও চলে গেলেন, রইলো বাকি এক  

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৩, ২৪ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৭:৩৩, ২৬ জুলাই ২০২১
ফকির আলমগীরও চলে গেলেন, রইলো বাকি এক  

ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই ও আজম খান

কাল মধ্যরাতে ফেইসবুকে ফকির আলমগীরের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১। একটা অনিন্দ্য সুন্দর সংখ্যা! অথচ আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম ২১ বছরের এক তাগড়া যুবক। ঝাকড়া চুলের বাবরি দুলিয়ে রাগী রাগী মুখ করে প্রতিবাদের গান গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছেন অনন্তের দিকে। এবং সত্যি সত্যি চলেই গেলেন আমাদের ‘জন হেনরি’।

কালো পাথরে খোদাই ঝলমলে পেশীর অকুতোভয় শ্রমিক, যে হাতুড়ির আঘাতে পাথরে পাথরে আগুন জ্বালায়, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় সাহেবের আনা স্টিম ড্রিলকে; চলে গেলেন সেই শব্দসৈনিক। চলে গেলেন ঢাকার সেই যুবক রিকশাঅলা, যে তাঁর প্রেমিকার জন্য বিরহ ছড়িয়ে যেত এই জান্তব শহরের পথে পথে। চলে গেলেন পার্বতীপুর রেল স্টেশনে বহুদিন পর প্রেমিকার দেখা পাওয়া যুবকটি। চলে গেলেন সান্তাহার স্টেশনের বিরহী প্রেমিক। চলে গেলেন কাল্লু মাতবরের কাছে প্রতারিত হওয়া যুবক। নেলসন মেন্ডেলার জন্মদিনে ঝাকড়া চুলে যে যুবক হাজির হতেন টিভি পর্দায়, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে- তিনিও চলে গেলেন।


আমরা যারা আশির দশকে বড়ো হয়েছি, আমাদের কাছে গান নিছক বিনোদন ছিল না। রুদ্ধমনের দুয়ার খুলে দেয়ার মন্ত্র ছিল গান। অনেকটা যেন আলিবাবার চিচিং ফাঁক! মুহূর্তে আমাদের মুখে রাষ্ট্রের বুঁজে দেয়া ছিপি যেন উড়ে যেত। যে কথা মুখে নিতে বারণ, যে প্রতিরোধ রাস্তায় গড়া অসম্ভব, সেই কথা, সেই প্রতিরোধ সুরে-স্বরে দিব্যি করা যেত। আজম খান যখন অনুনাসিক সুরে গেয়ে উঠতেন- ‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে/ মা তার কাঁদে,/ ছেলেটি মরে গেছে/ হায়রে হায় বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ তখন আমরাও ‘হায়রে হায়’ বলে আফসোসে জ্বলে উঠতাম। ‘বাংলাদেশ’ নামের কিশোরটি তখন সামরিক জান্তা আর স্বাধীনতাবিরোধী ছেলেধরার হাতে বন্দি। 

তখন আমাদের রবীন্দ্র কিংবা নজরুল সঙ্গীত টানত না; পল্লীগীতিও। আমাদের কাছে গান মানে ছিল ‘ব্যান্ড’। পরে জানলাম এর পোশাকী নাম পপ সংগীত। এই ব্যান্ড সংগীতের তখন জমজমাট জায়গা চট্টগ্রাম। পার্থ বড়ুয়া, নাসিম আলী খান, নকীব খান, পিলু খান, কুমার বিশ্বজিৎ, আইয়ুব বাচ্চু, তপন চৌধুরীরা তখন তারকার দ্যূতি নিয়ে উঠে আসছেন জাতীয় পর্যায়ে। টিভি বলতেই তখন বিটিভি। ঈদ-পার্বণে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান হলেই দেখা মিলত তাদের। নিজের শহরের তরুণদের মুখ দেখে আমরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তাম!

কিন্তু টিভির পর্দা তখন এরা নয়, শাসন করতেন পাঁচ তরুণ-তরুণী। তাঁরা তখন আমাদের কাছে রীতিমতো ক্রেজ। এঁরা হলেন: আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ আর ফকির আলমগীর। এই পাঁচজন তখন বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের পঞ্চ পাণ্ডব। এদের দেখে প্যান্টের কাটিং ঠিক করে তরুণরা। চোখে চশমা লাগায়। লম্বা চুল রাখে। তেছড়া করে তাকায়। কী এমন সম্মোহনী শক্তি ছিল এদের?

অন্যরা যখন পাশ্চাত্য সংগীতের মূর্ছনায় প্রেম বিরহ আর নৈমিত্তিক জীবনের কথা তুলে আনছেন, পঞ্চপাণ্ডবের কণ্ঠে তখন প্রতিরোধের সুর। শোষিত মানুষের পক্ষের স্বর। তাদের চলন-বলনে সাধারণ মানুষের আবেগ। শৃঙ্খল ভেঙে দেয়ার ঔদ্ধত্য।


আশি ও নব্বইয়ের দশকে একটা বড়ো সময় কাটত হারতাল আর অবরোধে। হরতাল হলে অসময়ে (তখন বিকাল থেকে বিটিভির সম্প্রচার শুরু হতো) টিভি খুলে যেত। লক্ষ, কিশোর তরুণদের ঘরে আটকে রাখার ব্যবস্থা আরকি! চালিয়ে দেয়া হতো রাজ্জাক-ববিতার সিনেমা। এর ফাঁকে ফাঁকে চলত সংকলিত গানের অনুষ্ঠান। দুটো গান শোনার জন্য আমরা বাপ-ব্যাটা মুখিয়ে থাকতাম। এক. তুমি কী দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, দুই. ও সখিনা গেছস কিনা…।

শেষের গানের গায়ককে শুধু গানের জন্য নয়, তার চেহারা, ব্যক্তিত্বের কারণে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো।  চেহারায় আর দশজন শিল্পীর মতো একটা সুখী সুখী ভাব নেই। বরং বিপ্লবের অস্থিরতা চোখে-মুখে। দুরন্ত সাহসের ইঙ্গিত অঙ্গভঙ্গিতে। ঝাকড়া চুল। ভরাট গ্রীবা। দরাজ গলা। পর্দায় নাম ভেসে উঠত ‘ফকির আলমগীর’। আমার মতো লক্ষ লক্ষ কিশোরের কাছে তিনি তখন বিপ্লবের বাদশা। তার সুর যেন আগুন ধরিয়ে দেয় রক্তে।

কেবল সুরকার ও গীতিকারের কথা অনুকরণ করে ফকির আলমগীরের মতো একজন শিল্পী হওয়া যায় না। এ জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ‘ওরিয়েন্টেশন’ প্রয়োজন। ষাটের দশকে গণ-অভ্যুত্থানে সেই ওরিয়েন্টেশন হয়েছিল যুবক আলমগীরের। তিনি তখন ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সদস্য। গণ-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে যোগ দেন।

তাঁকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কেন গণসঙ্গীত গান? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘মাতৃপ্রেম বা দেশপ্রেম দুটোই আমাকে বেশ টানে। দেশপ্রেম আমাকে সাহস যোগায়। সংগীতের অনেক শাখা থাকার পরও আমি সারাজীবন গণসংগীত করেছি মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা থেকে। আর আমি আজও মানুষের জন্য গান গাই।‘


বাংলা পপ সংগীতের সেই পঞ্চ পাণ্ডবের মধ্যে চারজনই চলে গেলেন। সবার আগে গেলেন ফিরোজ সাঁই। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাস। আমি এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। রাতের সংবাদ জানলাম ফিরোজ সাঁই নেই। শিল্পকলা একাডেমির দর্শক ভর্তি হলে ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ গানটি গাইতে গাইতে চলে গেছেন তিনি। আসলেই তো জীবনের কোনো ভরসা নেই। 

২০১১ সালে গেলেন পিলু মমতাজ আর আজম খান। আজম খানের রোগক্লিষ্ট শরীরের নিউজ দেখতাম টিভিতে, আর মনে মনে কাঁদতাম। গুরু এভাবে চলে যাওয়া যাবে না। ‘আসি আসি বলে’ তিনিও চলে গেলেন।

কাল চলে গেলেন ফকির আলমগীর। রইলো বাকি এক। ফেরদৌস ওয়াহিদ। মামুনিয়াকে বিড়াল ছানার গান শোনাতে তিনিও হাজির হন না অনেকদিন। কামনা করি তাঁর দীর্ঘায়ু।


বিটিভির কল্যাণে বড়জোর ফকির আলমগীরের ৬/৭ টা গান ঘুরেফিরে কয়েকশ বার শোনা হয়েছে। বড়ো হয়ে জানলাম তার হাজারের উপরে গান রয়েছে। বেরিয়েছে ৩০টি অ্যালবাম। ‘সখিনা’ আর ‘পার্বতীপুর স্টেশনে’ সিরিজের ৭টি অ্যালবাম বাংলার শ্রমজীবী মানুষের অব্যক্ত কান্নার যেন মহাকাব্য হয়ে রয়ে যাবে। সাধারণ সব ঘটনা কী অসাধারণ গায়কী আর মমত্ববোধে তুলে ধরেছেন, তা কেবল একজন পেশাদারের  পক্ষে সম্ভব নয়। তার অধিক কিছু থাকতে হয়। যে সেই শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মেশেনি, তার সুখ দুঃখের ভাগী হয়নি, তার পক্ষে এমন দরাজ কণ্ঠে বিহ্বল আবেগে গাওয়া সম্ভব নয়। শবমেহের, উরিরচরের সখিনা, মুক্তি, টোকাই, সখিনার বিলাপ, শিখা অনির্বাণ অ্যালবামগুলো সেই ধারাবাহিকতা রেখে গেছে।


২০০৮ সালে ঢাকায় আসি। স্বপ্নলোকের মানুষদের সামনাসামনি দেখার সুযোগ হলো। ফকির আলমগীরকে বহুবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। কখনো শাহবাগে, কখনো বইমেলায়, কখনো অন্য কোথাও। তখন অবশ্য সেই তাগড়া যুবকটি বৃদ্ধপ্রায়। কিন্তু বিপ্লবের তেজ তারা চলাফেরায়। ধরে আসা গলায় দিব্যি এখানে-ওখানে গান গেয়ে বেড়ান। কোনো দ্বিধা নেই। মনে হয় এক বৃদ্ধ সিংহ দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছে বনের মধ্যে। কেশর ফোলানো সেই সিংহকেই যেন দেখতে পাচ্ছি মানসপটে। তিনি চলে যাচ্ছেন তার বনভূমি ছেড়ে। বিরাণ হয়ে যাচ্ছে সেই বনভূমি। আমরা শূন্য প্রান্তরে বসে হাহাকার শুনি।

বিদায় আমাদের গণসংগীতের বাদশাহ ফকির আলমগীর। বিদায় মানে চলে যাওয়া নয়। আপনি আমাদের রক্তে মিশে গেছেন। আপনার মৃত্যু নেই। সখিনারা আপনাকে কখনও ভুলবে না। আপনি আমাদের চেতনায় রক্তিম সূর্য হয়ে রইবেন।

 

আরো পড়ুন: 
ফকির আলমগীর: গণ-মানুষের কণ্ঠস্বর 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়