ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যে পারিবারিক শিক্ষায় তাদের বেড়ে ওঠা

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২২, ৫ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৬:৪১, ৫ আগস্ট ২০২১
যে পারিবারিক শিক্ষায় তাদের বেড়ে ওঠা

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এমন অনেক ঘটনার বিবরণ রয়েছে, যা আমাদের অশ্রুসিক্ত না করে পারে না। এর মধ্যে একটি ঘটনা আমরা পাই এভাবে- প্রায় আড়াই বছর কারাযন্ত্রণা ভোগের পর তিনি ১৯৫২ সালের অমর ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সময় অনশন ধর্মঘট পালন করেন। রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। তাকে মুক্তি দেওয়া হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যান গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে। তখন বড় মেয়ে শেখ হাসিনার বয়স সাড়ে চার বছর এবং পুত্র শেখ কামালের আড়াই বছর। তিনি লিখেছেন: ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু মাঝে মাঝে খেলা পেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলি। আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, আমি তো তোমারও আব্বা।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২০৯]

শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। ওই বছরের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এক মাসের বেশি কাটান। ফিরে এসেই বন্দি হন, যা স্থায়ী হয় প্রায় প্রায় আড়াই বছর। এ সময় মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে কারাগারে এসে পিতাকে দেখেছেন দুয়েকবার, তবে তা স্মৃতিতে থাকার কথা নয়। পিতাকে চেনার সুযোগ হয়নি পুত্রের!

বঙ্গবন্ধু কৈশোর থেকেই দেশের জন্য, দশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। প্রিয়তম স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা কেবল এটা মেনে নেননি, সর্বতোভাবে উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই নিয়ে তিনবার বঙ্গবন্ধু জেলে এসেছেন। পাঁচ বছরের পাকিস্তানে তাঁর জেলে কেটেছে প্রায় তিন বছর। এবারের জেল জীবনেই একবার স্বামীকে বেগম মুজিব বলেন, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৯১]

১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তির ঠিক দুই মাস পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। শুরু হয় প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সফর। ততদিনে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ গেছে সর্বত্র- ‘রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত হলে অ্যারেস্ট হিম অ্যাগেইন।’ [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৬]

ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান সফরে যান, উদ্দেশ্য রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সেখানে জনমত গঠন। সেখানে অবস্থানকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে চিঠি লেখেন ১৪ জুন (১৯৫২)। এ চিঠির একটি বাক্য ছিল এমন: ‘Please don't think for me. I have born to suffer.' [গোয়েন্দা রিপোর্ট, দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩৮]

বঙ্গবন্ধুর এই কষ্ট স্বীকার ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, উন্নত বিশ্বের সারিতে এ জনপদ নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ জন্য পিতা-মাতা এবং স্ত্রী-পুত্র-কন্যার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তারাও এ সব হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে সব গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে আমরা পাই তৃতীয় সন্তান শেখ জামালের জন্মকালের একটি মর্মস্পর্শী বিবরণ। ১৯৫৩ সালের ১৪ মে পাকিস্তানের গোয়েন্দারা ‘অসাধারণ দক্ষতায়’ ঢাকার জিপিও থেকে ‘আটক’ করে একটি চিঠি, যাতে ৫ মে তারিখ দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘স্নেহের রেণু। আজ খবর পেলাম তোমার একটি ছেলে হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ। খুব ব্যস্ত, একটু পরে ট্রেনে উঠব। ইতি তোমার মুজিব।’ [গোয়েন্দা রিপোর্ট, তৃতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩৩]

শেখ জামালের জন্মের পর লেখা এ চিঠিটি কি প্রাপক বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে পৌঁছে ছিল? পৌঁছালে চিঠিটা চোখের জলে কতটা সিক্ত হয়েছিল? গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ৫ মে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ ঈশ্বরদীগামী ট্রেনে ওঠেন। পরদিন পাবনায় ছিল জনসভা।

কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধু সে সময় ছিলেন চট্টগ্রামে, আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে নিয়ে জনসভায়। রাসেলের বয়স দেড় বছর হতে না হতেই বঙ্গবন্ধু ফের কারাগারে, মুক্তি সনদ ছয় দফা প্রদানের অভিযোগে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘রাসেল ওর মাকেই আব্বা ডাকছিল। রেণু বলছিল, বাড়িতে আব্বা আব্বা করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে।’ [পৃষ্ঠা ২২১]

এ তারিখেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘সংসার কীভাবে চলবে, জেল গেটের সাক্ষাৎকারে সে আলোচনা ওঠায় রেণু বলল, ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না। সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি।’ [পৃষ্ঠা ২২২]

২৩৩ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন: বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললাম।... আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে কাটাইয়াছি তোমাদের মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও। ছোট মেয়েটা বলল, আব্বা তোমর জেল এক বৎসর হয়ে গেল। আমি ওকে আদর করে বললাম, আরও কত বৎসর যায় ঠিক কি?’

বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের জীবন ছিল সাদামাটা, আর সব সাধারণ বাঙালি পরিবারের মতো। শেখ হাসিনার বিয়ে হয়েছে ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে একেবারেই ঘরোয়াভাবে, যখন আগরতলা মামলা দায়েরের ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে। তিনি ইডেন কলেজ ইন্টারমিডিয়েট শাখার নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। শেখ কামালের সঙ্গে আমি একসঙ্গে ছাত্র আন্দোলন করেছি। ছাত্রলীগের সব কাজে সামনের সারিতে। এ সংগঠনের ঢাকা নগর কমিটি কিংবা কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে সহজেই নির্বাচিত হতে পারতেন। ১৯৭০ কিংবা ১৯৭২ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হতে চাইলেও কেউ আপত্তি করতেন না। কিন্তু এ ধরনের পদে তাঁর আগ্রহ দেখিনি। স্বাধীনতার পর আবাহনী ক্রীড়াচক্র গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের ফুটবলে আধুনিকতার ধারা সূচনা হয় এ টিমের হাত ধরে। ১৯৭২ সালে জার্মানি সফরে গিয়েছিলেন শেখ কামাল। তখন একটি দোকানে উন্নত মানের ফুটবল দেখে কিনতে চাইলেন। কিন্তু পকেটে যথেষ্ট অর্থ না থাকায় শেষ পর্যন্ত একটি নীল জার্সি নিয়ে দেশে আসেন। এ রংয়ের জার্সিই আবাহনীর জার্সি হয়ে যায়। অথচ তিনি তখন জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র। বহুবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় ছিলেন। নাট্যচক্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু আচরণে, ব্যবহারে থেকেছেন সাধারণের মতো।

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি তাঁর বিয়ে হয় বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সুলতানা খুকির সাথে। আমরা তখন একসঙ্গে জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। বিনয়ের সঙ্গে নিমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন, আব্বা-মা আপনাদের সবাইকে বিয়েতে যেতে বলেছেন। বৌভাতে আয়োজন ছিল সিঙ্গারা ও চমচম। কয়েকদিন পর শেখ জামালের বিয়ে হয় একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশে।

বিয়ের সময় সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল যে শাড়ি পরেছিলেন, বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে তা সবার দেখার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। আমি একবার সেখানে থাকার সময় সেখানে কয়েকজন দর্শনার্থী উপস্থিত হন। তারা রায়ের বাজারের একটি বস্তিতে থাকেন, এমনটিই মনে হয়েছিল তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনায়। এই দলে থাকা দুটি মেয়ে একে অপরকে বলছিল- ‘দেখ দেখ, আমগো বস্তির মতো শাড়ি।’

জাতির পিতা ও বঙ্গমাতা এভাবেই সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছেন। অথচ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে এবং বেগম মুজিব রয়েছেন ধানমন্ডির একটি বাসায় বন্দিজীবনে। সর্বত্র চলছে গণহত্যা। সেই ভয়ঙ্কর সময়ে বেগম মুজিব দুই পুত্র কামাল ও জামালকে পাঠালেন মুক্তিবাহিনীতে- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে নির্মূলের জন্য। রণাঙ্গনে তারা লড়েছিল বীরের মতো। বঙ্গবন্ধুও ফিরে আসেন মুক্ত স্বদেশে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে শেরে বাংলা নগরে নতুন গণভবন তৈরি হয়ে যায়। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ছোট বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গণভবনে উঠবেন, এটাই ধারণা করা হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেন, সরকারি ভবনের আরাম-আয়েশে প্রতিপালিত হলে ছেলেমেয়েদের মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণে অহমিকাবোধ ও উন্নাসিক ধ্যানধারণা সৃষ্টি হবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। [সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ : এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পৃষ্ঠা ১৭৪]
এই তো আমাদের জাতির পিতার পারিবারিক মূল্যবোধ!

 

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
        
আরো পড়ুন: শেখ কামাল সৃষ্টি সম্ভাবনাময় তারুণ্যের প্রতীক 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়