ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি, এটাই যেন শেষ ঘটনা হয়

রাজন ভট্টাচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ৬ জুন ২০২২   আপডেট: ০৯:৫৪, ৬ জুন ২০২২
সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি, এটাই যেন শেষ ঘটনা হয়

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের যে ঘটনা ঘটেছে গোটা বিশ্বে এটাই কী প্রথম? নাকি আরও ঘটেছে। সংখ্যায় কম হলেও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় অভ্যস্ত। চীন, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে এমন ঘটনা ঘটলেও দেশে এবারই প্রথম। বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও বেশি। অন্যান্য দেশের ডিপোতে লাগা অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ঘটনা থেকে তারা শিক্ষা নিয়ে নতুন করে পথ চলতে শুরু করেছে। আমরা কী পারবো?

বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দেওয়া এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এনেছে। এর একটি হলো ডিপো মালিকের কী বিচার হবে? অপরটি হলো ঘটনা যেন ফের না ঘটে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কী নেওয়া হবে? তাছাড়া ডিপোতে থাকা কনটেইনারে দাহ্য পদার্থ ছিল তা কেন গোপন রাখা হয়েছে বা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছারপত্র পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। হতাহতরা প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ পাবে? 

শনিবার রাতে অগ্নিকাণ্ডের পর রোববার ফায়ার সার্ভিসের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা বলছিলেন, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জাম নেই। সেইসঙ্গে ডিপোতে কেমিক্যাল রাখার বিষয়টি তাদের জানানো হয়নি। এজন্য বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। ফায়ার সার্ভিসের দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমতির তালিকায় ‘স্মার্ট গ্রুপের’ এই ডিপোর নাম নেই।  দুপুর পর্যন্ত কোন কনটেইনারে কী আছে তাও জানতে পারেনি উদ্ধারকারী দল। এত বড় দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেওয়া ডিপো মালিকের ঠিক হয়নি। এতে তিনি আরও বেশি অপরাধ করেছেন। যদিও মালিক কর্তৃপক্ষ বিকাল থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির হিসাব দিয়ে যাচ্ছিল!

তাদের কাছে হতা-হতরা বড় নাকি ক্ষয়ক্ষতি বড় সেটাই প্রশ্ন? ভয়ঙ্কর একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, আগে সে চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘটনাস্থলে মালিকপক্ষের  আসা উচিত ছিল। তার পক্ষ থেকে উদ্ধারকারী টিমকে সহায়তা বা তথ্য সরবরাহ করলে কাজটি হয়ত আরও বেশি এগিয়ে যেত। বড় কথা হলো কোন কিছুকে পাত্তা না দেওয়ার প্রবণতা তো দেশের নতুন কিছু নয়।

আমরা নিমতলী ও রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডি দেখেছি। চুড়িহাট্টা থেকে শুরু করে বনানী এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখেছি। অভিযান-১০ লঞ্চ ও শীতলক্ষা, বুড়িগঙ্গায় সর্বশেষ নৌডুবির ঘটনাও সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১২৪ জন। এ ঘটনার ঠিক ১২ বছর পরেই সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোয় ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিকের বেশি নিহত হয়েছেন। আহত দুই শতাধিক।

দেশের অগ্নিদুর্ঘটনার ইতিহাসে আরও একটি স্মরনীয় দিন হলো ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। মানুষ যখন একুশের ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে জেগে ছিলেন, ঠিক তখন পুরান ঢাকার চকবাজারে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৬৭ জন। সিলিন্ডারের বিষ্ফোরণ থেকেই মূলত ওই দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়াও ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার উত্তরে টঙ্গীতে একটি সিগারেট কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ হারান ৩১ জন। ওই ভবনের নীচে ছিল রাসায়নিক গুদাম।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশন ফ্যাক্টরির ৯ তলা ভবনে আগুন লেগে প্রাণ হারান ১১২ জন শ্রমিক। ২০১৭ সালের ৪ জুলাই গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার পেছনে বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জন মানুষ প্রাণ হারান।

আজ পর্যন্ত এসব ঘটনার কি কেউ দায় স্বীকার করেছেন? অথচ প্রতিটি দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা মালিকের ত্রুটি ছিল। তদন্তের তা প্রমাণিত। অথচ বিচার কি হয়েছে? বা ঘটনার আবারো পুনরাবৃত্তি হবে না? এমন নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারছে না।

এনটিভি ভবনে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের পরই কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের উন্নত উদ্ধারকারী সরঞ্জাম কেনার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এখন পর্যন্ত কত কোটি টাকার উদ্ধার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে? যা আছে তাও তো পর্যাপ্ত নয়। এই শহরে একের পর এক বড়-বড় অট্টালিকার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। অথচ উদ্ধারকারী সরঞ্জাম অপ্রতুল। এটা তো হতে পারে না। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।

তা না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকারী টিমের সদস্যদেরও প্রাণ দিতে হয়। যেমন হয়েছে সীতাকুণ্ডে। এরকম মর্মান্তিক মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবার। একটি পরিবার থেকে একজন মানুষের হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা শুধু পরিবারের লোকজনই ভালো বোঝেন। বিশেষ করে স্ত্রী, সন্তান ও মা-বাবা।

আমাদের কারো কোনভাবেই এমন দুর্ঘটনা কাম্য হতে পারে না। যারা এসব ঘটনার জন্য দায়ী তাদের বিবেকের জায়গাটি কতটুকু শক্ত কে জানে? তাদের ক্ষেত্রেও তো এমন বিপর্যয় আসতে পারে। নিজে হতে পারেন দুর্ঘটনার শিকার। তাই দল ও মতের ঊর্ধে উঠে সবক্ষেত্রে সব দুর্ঘটনার বিচারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

বিএম কনটেইনার ডিপোয় প্রায় ২০ হাজার কনটেইনার রয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে বেশকিছু কনটেইনারে দাহ্য পদার্থ ছিল। আর সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটে। যেখানে মজুত ছিল হাইড্রোজেন পার অক্সাইড।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, ১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপো রয়েছে দেশে। রাজস্ব বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার এসব ডিপোতে এনে খালাস করা বাধ্যতামূলক। আবার বন্দরে এখন কোনো রপ্তানি পণ্য কনটেইনারে বোঝাই হয় না। রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ কারখানা থেকে এসব ডিপোতে এনে কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়।

১৯৮৪ সালে সি ফেয়ারার্স লিমিটেড নামে আইসিডি চালুর মাধ্যমে দেশে বেসরকারি আইসিডির যাত্রা শুরু হয়। এরপর কোনো নীতিমালা ছাড়াই ২০২১ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে ১৯টি বেসরকারি আইসিডি। ২০১৬ সালে অফডক নীতিমালা অনুযায়ী, বন্দরের ২০ কিলোমিটারের বাইরে অফডক স্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে। 

পিএসএসের (পোর্ট স্কিলস অ্যান্ড সেফটি পলিসি) গাইডলাইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ করে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করার কথা বলা হলেও দেশের কোনো আইসিডিতেই তা মানা হয় না। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সেইফটি ম্যানুয়াল, হ্যাজার্ড মার্কিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে পিএসএস নীতিমালায়।

ফায়ার সার্ভিস ও ডিপো সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্মার্ট গ্রুপের বিএম কনটেইনার ডিপোসহ অন্য সব ডিপোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে মারাত্মক ত্রুটি। দাহ্য পদার্থ আমদানিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কড়াকড়ি নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।

শেষ কথা হলো, এই ডিপোর মালিক, তিনি যদি দায়িহীনতার পরিচয় দিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলেন এর চেয়ে কষ্টের কী হতে পারে? তাহলে নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের থেকে মানুষ কী শিখবে? তিনি দুর্ঘটনার জন্য সব দায় স্বীকার করবেন কিনা জানি না। 

তবে এটুকু বলতে চাই, সুষ্ঠু তদন্ত শেষে ঘটনার বিচার করতে হবে। ডিপোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সবগুলো কন্টেইনার ডিপোতে কি ধরণের পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে তা তদারকি করা উচিত। সেইসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার সরঞ্জাম কিনার বাজেট বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে দুর্যোগ থেকে মুক্তির প্রযুক্তি। এমন দুর্যোগ মোকাবিলায় নতুন নতুন গবেষণারও বিকল্প নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

/সাইফ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়