ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বাজেট ঘাটতি: ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু প্রয়োজন

নিরঞ্জন রায়  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ৩ জুন ২০২৩  
বাজেট ঘাটতি: ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু প্রয়োজন

অর্থমন্ত্রী মহান সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জন্য জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন। সরকারের বর্তমান মেয়াদে এটাই শেষ বাজেট। ফলে বাজেট তৈরি ছিল সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের। যদিও সরকার বিগত তিন বছর এই চ্যালেঞ্জের বাজেট দিয়ে আসছে।

২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থ বছর ছিল করোনা মহামারীর কারণে চ্যালেঞ্জের বছর। সেই চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই সরকারকে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করতে হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থ বছর তো  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের বছর। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়েই সরকারকে জাতীয় বাজেট পেশ করতে হয়েছে। সত্যি বলতে কি সরকার চ্যালেঞ্জ বা কঠিন সময়ে বাজেট প্রণয়নে বলা যায় পারদর্শী হয়ে গেছে। সেই বিবেচনায় চ্যালেঞ্জ বা অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন বর্তমান সরকারের জন্য মোটেই নতুন কিছু নয়। তবে বিগত তিন বছরেরে তুলনায় এবারের বাজেট প্রণয়নে দুটো নতুন মাত্রার চ্যালেঞ্জ সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হয়েছে। যার একটি হচ্ছে এই বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন। আরেকটি হচ্ছে আইএমএফ’র শর্ত। 

দীর্ঘদিন পর, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের দীর্ঘ এক যুগেরও অধিক সময়ের শাসনামলে এবারই প্রথম বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইএমএফ’র সুপারিশ বিবেচনায় নিতে হয়েছে। এতসব বিষয় মাথায় রেখে সকল প্রকার চ্যালেঞ্জ এবং সংকটের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার উদ্দেশ্যে জাতীয় বাজেট পেশ করতে পেরেছে- এজন্য সরকারকে সাধুবাদ।   

বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য দেশি এবং বিদেশি উভয় উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের পথ খোলা রাখা হয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। এত বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ঠিক নয়। আমাদের দেশের বাজেটের আকার বেড়েছে বহুগুণ, কিন্তু সেই গতানুগতিক ধারার ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বাজেট ঘাটতির উল্লেখযোগ্য অংশ মেটানোর সহজ উপায় থেকে বের হতে পারিনি। দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে সহায়তা দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করার কারণে বাজেটের আকার চলে গেছে ভিন্ন মাত্রায়। তাই এই বিশাল আকারের বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য অর্থের বিকল্প উৎস কাজে লাগাতে হবে এবং তা হতে পারে বন্ড ইস্যু করা। 

এত বিশাল আকৃতির বাজেটের অর্থসংস্থানের জন্য কোনো অবস্থাতেই ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভর করা বাস্তবসম্মত নয়। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারি বা সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার যে সকল বন্ড বাজারে ছাড়ে সেগুলো এক ধরনের সার্বভৌম মর্যাদা ভোগ করে। ফলে ধনাঢ্য ব্যক্তি, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সংস্থার মধ্যে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ থাকে। ফলে সঞ্চয়পত্রের চেয়ে কম সুদ তো বটেই, এমনকি ব্যাংক ঋণের থেকেও অপেক্ষাকৃত কম সুদে এই বন্ড বাজারে ছেড়ে সরকার বাজেট ঘাটতির প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। 

অর্থনীতিতে যদি মুদ্রা সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ এবং বন্ড ইস্যু করে বাজেট ঘাটতি মেটানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের তেমন কোন পার্থক্য হবে না। কেননা সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে ব্যাংকের বেসরকারি খাতে ঋণদান ক্ষমতা হ্রাস পাবে। আবার সরকার যদি বন্ড ইস্যু করে, তাহলে অনেকেই ব্যাংকে আমানত রাখার পরিবর্তে সরকারী বন্ডে বিনিয়োগ করবে। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকিং খাতে সঞ্চয় হ্রাস পাবে যা প্রকারান্তরে ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতাকেই সীমিত করবে। মুদ্রাবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই ধরনের অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকলেও অন্যান্য কিছু তারতম্য অবশ্যই আছে। ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু করে বাজেট ঘাটতি মেটালে সরকারের ঋণ বাবদ ব্যায় হ্রাস পাবে। বন্ড ইস্যু করলে সরকার ব্যাপক হারে ব্যাংক ঋণ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত হবেনা এবং সমালোচনারও কোন সুযোগ থাকবে না। 

তাছাড়া বন্ডের অর্থ পরিশোধে সরকারের একটা স্বাধীনতা থাকবে। সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদের বন্ড ইস্যু করবে যা মেয়াদপূর্ণ (ম্যাচুউরড) হবে সরকারের নগদ প্রবাহের (ক্যাশ ফ্লো) সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন মেয়াদে। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে এই সুযোগ একেবারেই নেই। অন্যদিকে ব্যাংকে বৃহৎ অংকের সঞ্চয় হ্রাস পাবার কারণে ব্যাংক তখন তাদের সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য দেশের ক্ষুদ্র এবং ব্যাক্তিগত সঞ্চয় সংগ্রহের দিকে মনোযোগী হবে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ক্ষুদ্র আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে যা ব্যাংকিং খাতের ভিত্তিকে মজবুত করবে। ক্ষুদ্র এবং ব্যাক্তিগত সঞ্চয় যে শক্তিশালী ব্যাংকিং খাতের জন্য কতটা অত্যাবশ্যিক তা আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্ব এবার হারে হারে টের পেয়েছে। 

এতসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর আমাদের দেশের বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য কেন যে বন্ড ইস্যু না করে ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভর করা হচ্ছে তা আমাদের কাছে মোটেই বোধগম্য নয়। একমাত্র কারণ হতে পারে যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার কাজটা বেশ সহজ। যার সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রতিবছর বাজেটের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একের পর এক মেগাপ্রকল্প গৃহীত হচ্ছে। সবচেয়ে বড়কথা, আমরা ২০৩০ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছি। এরকম একটি অর্থনীতির দেশের সরকারকে বন্ড ইস্যু করেই অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক ঋণ বা অন্য কোন পথে নয়। 

উন্নত বিশ্ব তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশের সরকারও বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। আমেরিকা তো বন্ড ইস্যু করে কর্মচারীর বেতন দেয়, পেনসন প্রদান করে এবং পূর্বের ঋণও পরিশোধ করে। ঋণ নিতে না পারলে যে আমেরিকার মতো দেশ খেলাপি বা দেউলিয়ার পর্যায় চলে যায় তা তো বিশ্ববাসী সম্প্রতি খুব ভালভাবেই জানতে পেরেছে। আমরা অবশ্য চাই না যে আমেরিকার মতো ক্রেজি ঋণ বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের কোনো দেশই গ্রহণ করুক। 

সরকারের অর্থের প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মেয়াদের বন্ড ইস্যু করা যেতে পারে। প্রয়োজনে তিন মাস মেয়াদি স্বল্প মেয়াদি বন্ড থেকে শুরু করে পচিশ বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য বিভিন্ন মেয়াদের বন্ড ইস্যু করা সম্ভব। এমনকি নবায়নযোগ্য তিন মাস মেয়াদি বন্ডও ইস্যু করা সম্ভব। যাদের হাতে অল্প সময়ের জন্য অর্থ থাকবে তারা সেই অর্থ স্বল্প মেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবে। অনেকেই ভাবতে পারেন কাজটা বেশ জটিল হবে। মোটেই তা নয়। সার্বভৌম বন্ড বিশ্বে খুবই পরিচিত এবং জনপ্রিয় ফাইন্যান্সিয়াল প্রডাক্ট। এই বন্ডের ম্যানেজমেন্ট এবং অপারেশন সম্পর্কে অনেকেরই ভালো ধারণা আছে। প্রয়োজন কিছু পদক্ষেপ নেয়া এবং একটি সিস্টেম বা সফটওয়্যার নির্মাণ করা। দেশে বন্ড মার্কেট থাকলে কাজটা অনেক সহজ হতো। তবে বন্ড মার্কেট না থাকলে যে বন্ড ইস্যুর কাজ করা যাবে না তেমন নয়। অবশ্যই করা যাবে। আমাদের অর্থনীতি যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে কার্যকর একটি বন্ড মার্কেট অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। তবে যতদিন সেটি না হবে ততদিন বিকল্প পদ্ধতিতে এই বন্ড ইসু করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। 

যত সমালোচনা এবং সীমাবদ্ধতাই থাকুক না কেন, ঘাটতি বাজেট হচ্ছে বাস্তবতা। উদ্বৃত্ত বাজেট সাধারণত দেখা যায় না। আবার ব্যাল্যান্স বাজেট একটি অবাস্তব অবস্থা। ফলে ঘাটতি বাজেটই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয় ব্যাবস্থা। যত দিন যাবে ততই বাজেটের আকার বৃদ্ধি পাবে এবং সেই সাথে বাজেট ঘাটতির পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। একারণেই ক্রমাগত বর্ধিত ঘাটতি মেটানোর একটি স্থায়ী ব্যাবস্থা হিসেবে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ এখন থেকেই চালু করা প্রয়োজন।  

লেখক: সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়