আগস্ট প্রকৃতপক্ষে বাঙালির শোকের মাস
বঙ্গবন্ধুর পেইন্টিং শাহাবুদ্দিন আহমেদ
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আগস্ট অপূরণীয় এক ‘ক্ষতি’র মাস হিসেবে বারবার আবির্ভূত হয়! ঘটনার বিবেচনায় এবং সময়ের ব্যবধানে আগস্টেই বাঙালির অস্তিত্ব, নেতৃত্ব এবং সার্বভৌমত্বের মূলে আঘাত এসেছে।
এ সব ঘটনার কোনো কোনোটি মানবসৃষ্ট ভয়াবহ নৃশংসতা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। আজ থেকে ১৯ বছর আগের ঘটনা হলেও এর রেশ আজও বিদ্যমান। অত্যুক্তি হবে না, যদি বলা হয়, এই ঘটনার রেশ আরো অনেককাল আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে থেকে যাবে। কারণ সেই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন কমপক্ষে ৩০০ জন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এই হামলার ঘটনা অশনি সংকেত হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।
এরপর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ৬৩টি জেলার ৩০০ স্থানে প্রায় ৫০০ হাতে তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে চালানো এ সিরিজ বোমা হামলায় দুজন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। সে সময় ৬৪ জেলার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলা ব্যাতিত দেশের প্রতিটি জেলায় এই হামলা চালানো হয়েছিল। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ ছিল জঙ্গিদের টার্গেট। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারি আধা-সরকারি স্থাপনা ছিল। যা বাঙালির চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সরাসরি আঘাত। ঘটনাটি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিই শুধু নষ্ট করেনি, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট; সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের জঘন্য সেই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন মাত্র কয়েকজন সামরিক ব্যক্তি। পরে তাদের বিচার হলেও এ ঘটনার ইন্ধনদাতারা আজও অধরা। বড় বড় ঘটনার ভয়াবহতা আমাদের শঙ্কিত করে। এ সব ঘটনার ইন্ধন দাতাদের খুঁজে না পাওয়ার ইতিহাস যত দীর্ঘ হয়, আমাদের ভয় তত বাড়ে। কিন্তু আমরা মনেপ্রাণে চাই উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক, দেশের মাটিতে এমন ভয়াবহ ঘটনা আর না ঘটুক।
আগস্ট মাসটি প্রাকৃতিকভাবেও কখনো কখনো প্রলয়ঙ্কারী হয়ে উঠেছে। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেশের ইতিহাসের ‘ভয়াবহ’ বন্যা। সে সময় পুরো দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে চলে গিয়েছিল। বন্যা প্রায় ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। নানাবিধ মারাত্মক ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছিল জান, মাল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছিল সেই বন্যাসৃষ্ট দুর্যোগের চিত্র।
এই আগস্ট মাসে বাংলাদেশ অনেক কৃতি সন্তান হারিয়েছে। ক্যাপ্টেন সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা আজ বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম। তিনি বাংলাদেশের সরকারি বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রথম নারী বৈমানিক। বৃষ্টিবিঘ্নিত আবহাওয়ায় ১৯৮৪ সালের ৪ আগস্ট তিনি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ফকার এফ-২৭ বিমানে করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হন। সেই দুর্ঘটনায় ৪৫ জন যাত্রীসহ ৪ জন ক্রু সদস্য নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন একজন ব্রিটিশ নাগরিক, একজন জাপানি এবং ৩৩ জন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত বাংলাদেশি।
২০১২ সালের ১১ আগস্ট, কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাফায়াত জামিল (বীরবিক্রম) মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তিনি এবং খালেদ মোশাররফ খন্দকার মোস্তাক আহমেদের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ৬ নভেম্বর মোস্তাক রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। মোস্তাকের স্থলাভিষিক্ত হন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
বাংলাদেশের আরেক কৃতি সন্তান সন্তোষ গুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন ৬ আগস্ট ২০০৪। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। তার লেখা পাঠক মহলে সমাদৃত ছিল ‘অনিরুদ্ধের কলাম’ নামে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং পরে একই বছর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যার পরেও সন্তোষ গুপ্ত অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছিলেন।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর মৃত্যুবরণ করেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্দুর রহমান বয়াতির মৃত্যু হয় ১৯ আগস্ট, ২০১৩ সালে। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৫ সালে একুশে পদক লাভ করেছিলেন। নায়করাজ রাজ্জাককেও আমরা হারিয়েছি ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট। ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মুর্তজা বশীরকে।
২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমান মৃত্যুবরণ করেন। যার লেখায় স্থান পেয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ। ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং রাজনীতিক শওকত আলী মৃত্যুবরণ করেন।
আগস্ট প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জীবনে একটি শোকের মাস। ব্যক্তিগতভাবে এই মাস আমাকে শোকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এ মাসেই আমি আমার জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছি। যিনি ৪৩ বছর সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি গর্বিত, আমার পিতা মো. আফতাব উদ্দিন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন।
এই আগস্ট মাসে আমরা বাংলার যত কৃতি সন্তানকে হারিয়েছি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
তারা//