এভারেস্ট দিবস
এ দেশে যে প্রশ্ন শুনতে হয় ‘এভারেস্টে উঠলে কী হয়?’

পাহাড় জয়ের প্রচেষ্টা, ছবি: লেখক
এভারেস্টে উঠলে কী হয়? আমাদের দেশে এখনো সিংগভাগ মানুষেরই ধারণার বাইরে পর্বতারোহণের বিষয়টি। এমন হবারই কথা। কারণ আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি বসবাস করা মানুষ। পর্বতের সংজ্ঞায় যা বোঝায় তা আমাদের বাংলাদেশে নাই। হিমালয় পর্বত আছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, তিব্বত, পাকিস্তান এবং চীনে। ‘গ্রেট হিমালয়া’খ্যাত এই দেশগুলোর নানা অঞ্চলজুড়ে এই পর্বতশৃঙ্গের অবস্থান। এর মধ্যে মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে, কে-টু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা অন্যতম। এখন কথা হলো এসব পাহাড়ে উঠলে বা চড়লে কী হয়? কেনই-বা এসব পর্বতে চড়তে মৃত্যুঝুঁকি থাকা সত্তেও মানুষ ছুটে যায়?
কী এমন আছে পর্বতে? এসব প্রশ্নের উত্তরে অনেকে বলে থাকেন- এগুলো ব্যক্তিগত লাভ। তাতে দেশের কী লাভ হয়? চাকতি নিক্ষেপ, তীর ধনুক নিক্ষেপ বা ভলিবল ফুটবল ক্রিকেটের মতো খেলায় আপনার আমার কী লাভ হয়? যারা খেলে তাদের হয়তো লাভ হতে পারে। আপনি দেখলেন হাততালি দিলেন, একটু আনন্দ পেলেন। বিশ্বের বুকে যখন দেশের পতাকা সবার সামনে দেখানো হয় তখন আপনার বুক গর্বে ভরে ওঠে। এভারেস্টে চড়া টিভিতে সরাসরি দেখা যায় না, কারণ এটাকে এক্সট্রিম স্পোর্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘ভেতো বাঙালি’ বলে যে জাতিকে গালি দেওয়া হতো সেই জাতির ৭ জন সন্তান পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে পদচিহ্ন রেখে এলো এবং দেশের পতাকা বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলো; এতে এটুকু অন্তত প্রমাণিত হলো, এই দেশের তরুণরাও কঠিনতর কাজ করতে পারে। তাতে দেশের তরুণরা একটা দিকনির্দেশনা পায় যে, এই দেশের মানুষ যেমন কঠিন পরিশ্রম করে কৃষিকাজ করে ফসল ফলাতে পারে, তেমনি বিশ্ব রেকর্ড করে গিনেজ বুকে নিজের নাম এবং দেশের নাম লিখতে পারে। এতে কিন্তু সব শেষে দেশেরই লাভ।
এমন প্রশ্ন ১৯২৩ সালেও উঠেছিল, যখন জর্জ ম্যালরি এভারেস্ট আরোহণের জন্য তৃতীয়বার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কেন বারবার পর্বতে যান? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘কারণ এভারেস্ট সেখানে আছে।’ এবারে সপ্তম বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্টের চূড়া ছুঁয়েছেন ইকরামুল হাসান শাকিল। শুধু এভারেস্টে আরোহণই তার লক্ষ্য ছিল না, তিনি একটি বিশ্ব রেকর্ডও করেছেন। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত থেকে হেঁটে যমুনা নদী সাঁতরে পার হয়েছেন। ভারত হয়ে নেপালে প্রবেশ করে ৮৪ দিনে প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এভারেস্টে আরোহণ করেছেন শাকিল। যা গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। সম্প্রতি শাকিলের এই অর্জনের কথা ‘প্রথম আলো’য় ছাপা হলে জনৈক শিক্ষিত এক ব্যক্তি খুব বাজেভাবে স্যোশাল মিডিয়ায় মন্তব্য লিখেছেন, ‘এরা মানুষের কাছে হাত পেতে পেতে হিমালয়ে যায় কেন? জঘন্য লাগে ক্রাউড ফান্ডিং বিষয়টা।’ তিনি বাবর আলীকে উদ্দেশ্য করে সেখানে লিখেছেন, ‘ক্রাউড ফান্ডিং করে অন্নপূর্ণা যায় তারপর ঘুরে ফিলিপিন, আজব লাগে!’
প্রথমেই বলে নেই, এ ধরনের এক্সট্রিম স্পোর্টস কখনই স্পন্সরশীপ ছাড়া সম্ভব না। কারণ যে ৪০ লাখ টাকার মালিক সে কখনও এভারেস্ট চূড়াতে যাবে না। যার এই ক্ষমতা আর মনোবল আছে কিন্তু অর্থের যোগান নেই তাকে দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলোর স্পন্সরশীপের জন্য হাত পাততে হবে। সাকিব আল হাসানকে ব্র্যান্ডগুলো স্পন্সর করার জন্য বসে থাকে। কারণ সেখানে পণ্যের অনেক প্রচারণা হয়, তাতে ব্র্যান্ড ভ্যলু বাড়ে। কিন্তু এ ধরনের স্পোর্টসে মানুষ তেমনভাবে জানে না বা দেখে না। সুতরাং স্পন্সররাও এগিয়ে আসতে চায় না। ক্রাউড ফান্ডিং পৃথিবীব্যাপী একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। নানা কাজে বিদেশিরা ক্রাউড ফান্ডিং করে। যিনি মন্তব্য করেছেন তার হয়তো ধারণাই নাই এ ধরনের কাজ করতে কি পরিমাণ শারীরিক মানসিক আর আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। দুনিয়াব্যাপী নানা অভিযাত্রা এবং সৃজনশীল কাজের জন্য তারা হাত পাততে একটুও দ্বিধা করে না। তারা শুধু ব্যক্তিগতভাবেই না, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও হাত পাতে। এই ধরুন, গত ১৫মে পশ্চিমের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও নানা সৃজনশীল কাজে বৃত্তি দেওয়ার জন্য হাত পাতলো, অভিভাবকসহ ক্যম্পাস সংশ্লিষ্টদের কাছে; গণহারে ই-মেইল দিলো ‘গিভ ডে’ নামের দিনটিতে দানের আহ্বান জানিয়ে। পরদিন ঘোষণা করলো তাদের তহবিলে উঠেছে ২০ লাখ ৬০ হাজার ২৯ ডলার, ভাবুন একবার!
ক্রাউড ফান্ডিং যে বা যারা দেন তাদের মূলত নিজস্ব স্বার্থ, উদ্দেশ্য বা ভালোবাসা থাকে। স্পন্সর বাছবিচার ছাড়া টাকা দেয় না! তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য দেয়। আর যারা ব্যাক্তি পর্যায়ে দেন তারা খেলাটা ভালোবেসে দেন। নিজে কখনও ওই শিখরে যেতে না পারলেও, যে পারে তাকে সাহায্য করেন খুশি মনে।
পর্বত আরোহণের মতো স্পোর্টসে যে ধরনের প্রস্তুতি তাতে পর্বতারোহীদের জন্য লংটার্মে সার্ভিস করা সম্ভব হয় না। আবার সার্ভিসে যুক্ত হলে প্রস্তুতিতে ঘাটতি হয়, অনেক সময় জীবন দিয়ে তার মূল্য দিতে হয়। এ কাজ একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি স্পন্সরের সংখ্যাও খুব বেশি না। সারা পৃথিবীতেই অনেক পর্বতারোহী ক্রাউড ফান্ডিংয়ের সহায়তা নেন এবং অনেক সফল পর্বতারোহী এর আগেও নিয়েছেন। বাবর আলীসহ আরো অনেক পর্বতারোহী রয়েছেন এদেশেই, যারা নিজের অন্য প্রয়োজনকে ত্যাগ স্বীকার করে নিজের টাকা দিয়ে বা জিনিসপত্র বিক্রি করে পর্বতে গিয়েছেন, তার জন্য একটা বড় কলিজা লাগে যা সবার থাকে না।
একজন পর্বতারোহী যতই স্টেবল হোক, এক একটা অভিযানের যে বিশাল খরচ, দিনের পর দিন ব্যক্তিগত অর্থে তা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাবর, শাকিলের মতো আরও পর্বতারোহী আছেন যারা সমর্থন পেলে আরো অনেক রেকর্ড এই দেশকে এনে দিতে সক্ষম হবেন।
পৃথিবীতে ভিন্ন মত, ভিন্ন পথের অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, যারা আমজনতার মতো গৎবাঁধা কাজ করেন না। সব ধরনের আরাম আয়েশ আর জাগতিক ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে পারে, তাইতো তারা রেকর্ডও গড়তে পারেন। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে পৃথিবীব্যাপী এমন ঘটনা অনেক আছে। সবাইকে এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা ঠিক না।
বাকিদের মন্তব্যের সঙ্গে আমি একটু জুড়ে দিতে চাই, অ্যাডভেঞ্চার আর এক্সট্রিম স্পোর্টসে ক্রাউড ফান্ডিং করা জরুরি। কারণ তরুণ সমাজ আজ হতাশাগ্রস্ত। তারা এদের সাফল্য দেখে অনুপ্রেরণা পাবে যে, মানুষ চাইলেই অসাধ্যকে সাধন করতে পারে। মাদকের দিকে না ঝুঁকে সুন্দর একটা জীবনে পৃথিবীতে বিচরণ করে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। তরুণদের ভালো উদ্যোগে তাই নিজে থেকেই সহায়তা করা উচিত, স্পন্সরদের এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে দেশ ও জাতি পাবে একটি উপযুক্ত তরুণ সমাজ।
বাংলাদেশের পর্বতারোহণ যাত্রা
আজ ২৯ মে এভারেস্ট দিবস। ১৯৫৩ সালে নিউজিল্যন্ডের এডমন্ড হিলারি এবং দার্জিলিংয়ের শেরপা তেনজিং নোরগে প্রথম মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে তাদের পদচিহ্ন দিয়েছেন। ১৯৬৭ সাল থেকে হিমালয় ভ্রমণের সূচনা করেছেন বাংলা দেশের এক তরুণ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ মুকুল। অন্নপূর্ণা ট্রেকিংয়ের উপর তিনি একটি বই লিখেছিলেন ‘পাহাড় যখন ডাকে’।
এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ থেকে দুইজন তরুণ ২০০৩ সালে এভারেস্ট বেইজ ক্যম্পে গিয়েছিলেন। মুনতাসির মামুন ইমরান এবং রিফাত হাসান। ‘এভারেস্ট’ নামে মুনতাসির মামুনের বইয়ে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আছে। এরপর ২০০৪ সালে বাংলাদেশ থেকে চার জনের একটি দল যায় বেসিক মাউন্টেরিয়ারিং কোর্স করতে দার্জিলিংয়ের এইচএমআই অর্থাৎ হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট। ২০০৬ সালে মেয়েদের একটি দল যায় এভারেস্ট বেইজ ক্যম্পে। এরপর কয়েকটা এক্সপেডিশন হয় বাংলাদেশ থেকে। তারপর প্রথম বাংলাদেশের পতাকা এভারেস্টের চূড়ায় নিয়ে যান মুসা ইব্রাহিম ২৩ মে ২০১০। তিব্বতের দিক থেকে ২০১১ সালে এভারেস্ট সামিট করেন এম এ মুহিত এবং ২০১২ সালে প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্ট সামিট করেন নিশাত মজুমদার এবং দ্বিতীয়বার নেপালের দিক থেকে সামিট করেন এম এ মুহিত। ২০১২ সালের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী হিসেবে এভেরেস্ট সামিট করেন। ২০১৫ সালে ওয়াসফিয়া সেভেন সামিট অর্থাৎ সাত মহাদেশের সাতটি চূড়ায় সামিটের রেকর্ড করেন। ২০ মে ২০১৩ এভারেস্ট সামিট করেন সজল খালেদ। ফেরার পথে তিনি অসীম শূন্যতায় পাড়ি জমান। এরপর ১০ বছর কেটে যায় বাংলাদেশ থেকে কেউ সাহস করেনি এভেরেস্ট এক্সপেডিশনে যাবার। ২০২৪ সালের ১৯ মে ডাক্তার বাবর আলী ষষ্ঠ বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা তোলেন। এভারেস্ট থেকে নেমেই তিনি আবার ৮০০০ মিটারের লোৎসে পর্বতে আরোহণ করেন। ২০২৫ এর ১৯ মে সপ্তম বাংলাদেশী হিসেবে ইকরামুল হাসান শাকিল এভারেস্ট আরোহণ করেন সঙ্গে একটি বিশ্ব রেকর্ডও করেন।
বাংলাদেশে এখন পর্বতারোহণ জনপ্রিয় হচ্ছে। বেশ কিছু বছরে অনেকগুলো এক্সপেডিশন হয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে পর্বতে যাচ্ছেন। ২০১২ সালের মার্চে আমরা ৫জন বাংলাদেশ থেকে দার্জিলিংয়ে বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করতে গিয়েছিলাম। সেবার ৪ জন শেষ করতে পেরেছিলাম। এরপর উত্তর কাশিতেও অনেকে গিয়েছেন কোর্স করার জন্য। ফিরে এসে এক্সপেডিশনে গিয়েছেন। পর্বতারোহণ একটি দীর্ঘ সাধনার ব্যপার। জীবনযাপনের মধ্যে পর্বতারোহণের দর্শনকে লালন করতে হবে। এদেশের তরুণেরা অ্যাডভেঞ্চারে এখন বেশ আগ্রহী। হয়ত ভবিষ্যতে পর্বতারোহণের ব্যাপারেও তারা আগ্রহী হবে এবং বিশ্বে এ দেশের পতাকার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবে।
লেখক: পর্বতারোহী
ঢাকা/লিপি