ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

জলাতঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ গড়া হোক আমাদের প্রতিশ্রুতি

প্রফেসর মোঃ আহসানুল হক (রোকন) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫  
জলাতঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ গড়া হোক আমাদের প্রতিশ্রুতি

একটি ক্ষুদ্র কামড়, একটি আঁচড় কিংবা আক্রান্ত প্রাণীর লালার সামান্য সংস্পর্শ- এতটুকুই যথেষ্ট এক অনিবার্য মৃত্যুর জন্য। জলাতঙ্ক হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভাইরাসজনিত রোগগুলোর একটি। উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার পর এই রোগ থেকে বাঁচার ইতিহাস কার্যত নেই। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই রোগটি শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিরোধের চাবিকাঠি হলো সচেতনতা, সময়মতো টিকা এবং মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণীর স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে একই সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া। অর্থাৎ ওয়ান হেলথ (এক স্বাস্থ্য) দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণেই বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “Act Now: You, Me, Community”। এর আহ্বান স্পষ্ট: এখনই পদক্ষেপ নিন, আমি, আপনি, আমাদের সমাজ, সবাই মিলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। প্রতিবছর প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায়। অর্থাৎ প্রতি ১০ মিনিটে একজন মানুষ এই রোগে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে উৎস কুকুরের কামড় কিংবা আঁচড়, আর ভুক্তভোগীদের প্রায় অর্ধেকই শিশু। জলাতঙ্ক কেবল একটি রোগ নয়, এটি এক নীরব মানবিক ট্র্যাজেডি, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বহু দশক ধরে জলাতঙ্ক আমাদের জনস্বাস্থ্যের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ২০১১ সালে জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি (এনআরইপি) চালুর পর পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। সরকার স্নায়ুটিস্যু ভ্যাকসিন বন্ধ করে আধুনিক ইনট্রাডার্মাল টিকাদান চালু করেছে। সারাদেশে কামড় ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে বিনামূল্যে পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস দেওয়া হয়। পাশাপাশি শুরু হয়েছে কুকুরের জন্য গণটিকাদান কর্মসূচি (এমডিভি)। এর ফলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। 

২০১১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে ৭২৪ জন মানুষ জলাতঙ্কে মারা গেছেন। অথচ একই সময়ে ২৮ লাখেরও বেশি মানুষ বিনামূল্যে জীবনরক্ষাকারী টিকা পেয়ে বেঁচে গেছেন। মৃত্যুহার কমেছে, তবে এখনও প্রতি বছর দেশের প্রায় সব জেলাতেই নতুন কেস শনাক্ত হচ্ছে। সম্প্রতি গবাদিপশুর সংক্রমণ থেকে মানুষের মৃত্যুও নথিভুক্ত হয়েছে, যা আমাদের নতুনভাবে সতর্ক করে।

ঝুঁকির মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন শিশুরা। প্রায় ৪০ শতাংশ ভুক্তভোগী ১৫ বছরের নিচের শিশু। খেলতে গিয়ে বা কুকুরকে উত্ত্যক্ত করার সময় তারা সহজেই কামড় বা আঁচড়ের শিকার হয়। সচেতনতার অভাবে তারা ক্ষত দ্রুত ধোয় না, আবার সময়মতো টিকাও নেয় না। এর বাইরে ভেটেরিনারিয়ান, ভেটেরিনারি শিক্ষার্থী, ল্যাবকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, পৌরসভার প্রাণী নিয়ন্ত্রণকর্মী ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে কাজ করা মানুষও উচ্চঝুঁকিতে রয়েছেন। 

প্রতিরোধের পথ আজ সুস্পষ্ট। প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের পর অবিলম্বে অন্তত ১৫ মিনিট সাবান-পানি দিয়ে ক্ষত ধোয়া প্রথম জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপ। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত শিডিউলে নিতে হবে; গুরুতর ক্ষেত্রে র‍্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন প্রয়োগ অপরিহার্য। উচ্চ ঝুঁকির পেশাজীবীদের জন্য প্রি-এক্সপোজার টিকা বাধ্যতামূলক করা দরকার। প্রাণীর মধ্যে রোগ প্রতিরোধে পথকুকুরের অন্তত ৭০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা আবশ্যক।

তবে শুধু টিকা যথেষ্ট নয়। পথকুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধরা- বন্ধ্যাকরণ- ভ্যাক্সিন প্রদান- মুক্তি (সিএনভিআর) পদ্ধতি, যেখানে কুকুর ধরা হয়, বন্ধ্যাত্বকরণ করা হয়, টিকা দেওয়া হয় এবং পুনরায় মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে পথকুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে, টিকার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আক্রমণাত্মক কুকুরের সংখ্যা কমে। সিএনভিয়ার ও এমডিভি একসাথে চালানো গেলে জলাতঙ্কের সংক্রমণ চক্র কার্যকরভাবে ভাঙা সম্ভব।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই কিছু কাঠামোগত পদক্ষেপ নিয়েছে। ইন্টিগ্রেটেড বাইট কেস ম্যানেজমেন্ট (আইবিসিএম) চালু হয়েছে, যেখানে মানুষ ও প্রাণীর কেসসমূহ যৌথভাবে অনুসন্ধান ও রিপোর্ট করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে ‘ন্যাশনাল র‍্যাবিস স্টিয়ারিং কমিটি’ গঠিত হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে- গ্রামীণ এলাকায় টিকার অপ্রাপ্যতা, কোল্ড চেইনের দুর্বলতা, সিএনভিআর কার্যক্রমের ধীরগতি এবং জনসচেতনতার সীমাবদ্ধতা। এসব ঘাটতি পূরণে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

শিশুদের সুরক্ষিত করতে প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলামে জলাতঙ্ক প্রতিরোধের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যার মাধ্যমে শিশুদের কুকুরের সঙ্গে নিরাপদ আচরণ, কামড় লাগলে তাৎক্ষণিক  সাবান ও পানি দিয়ে ক্ষত ধোয়া, দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া এবং পোষা কুকুরের নিয়মিত টিকার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা যাবে। নাটিকা, চিত্রকল্প ও গল্পের মাধ্যমে শেখানো হলে শিশুরা কেবল নিজেদের নয়, পরিবারের ও সমাজেরও সচেতনতার দূত হয়ে উঠবে।

এই প্রেক্ষাপটে ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট, সিভাসু নেতৃত্ব দিতে পারে। ওয়ান হেলথ ধারণার মূল ভিত্তি হলো—মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্য একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইনস্টিটিউটটি ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষার্থী ও কর্মীদের জন্য প্রি- ও পোস্ট-এক্সপোজার টিকা নিশ্চিত করা, চট্টগ্রাম নগরে ওয়ার্ডভিত্তিক পথকুকুরের টিকাদান ও জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করা, ল্যাবভিত্তিক ভাইরাস কনফার্মেশন ও মলিকুলার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংক্রমণপথ শনাক্ত করা, একই সাথে প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলামে জলাতঙ্ক প্রতিরোধের কনটেন্ট তৈরি ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং সর্বোপরি জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল নীতিমালার মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়নের এক অনন্য হাব হয়ে উঠতে পারে। 

একইসঙ্গে একটি ডেটা ড্যাশবোর্ড তৈরি করে জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর রিপোর্টিংয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন সম্ভব। তবে এ জন্য প্রয়োজন সকলের সমন্বিত সহযোগিতা, সদিচ্ছা ও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং তার সুপরিকল্পিত ব্যয়। অতএব, জলাতঙ্ক যত ভয়ঙ্কর, প্রতিরোধ ততটাই সহজ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছে, এখন লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্কজনিত মৃত্যু শূন্যতে নামিয়ে আনা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ - ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস- ২০২৫ এর প্রতিপাদ্য “Act Now: You, Me, Community” আমাদের এই পথেই আহ্বান জানায়। তাই আর দেরী নয়, এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। ওয়ান হেলথ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যকে একীভূত করে, সম্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই সম্ভব একটি নিরাপদ, সুস্থ ও জলাতঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

লেখক: পরিচালক, ওয়ান হেলথ্ ইন্সটিটিউট, সিভাসু

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়