ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শত বাধা পেরিয়ে আমার পথচলা    

কাফিয়া কুইন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ১৪ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৭:৫৩, ১৭ এপ্রিল ২০২১
শত বাধা পেরিয়ে আমার পথচলা    

‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি’ আমি কাফিয়া কুইন এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী। আমার জন্মস্থান ফরিদপুর ও বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। বাবা বিমান বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আর মা একজন গৃহিণী। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। 

আমরা দুই বোন এক ভাই। ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। আমার মা, তাকে দেখেছি সবসময় ব্যস্ত থাকতে। সে একজন পরিশ্রমী নারী। তার প্রতিভা ছিল অনেক। কিন্তু পরিবার থেকে তাকে সহায়তা করা হয়নি, সবসময় তাকে বোঝানো হয়েছে যে, তাকে গৃহিণী হিসেবেই থাকতে হবে, বাইরে চাকরি করা যাবে না। 

আমার অনুপ্রেরণা আমার মা। ছোটবেলা থেকে আমার মাথায় একটা চিন্তা কাজ করত, আমাকে কিছু একটা করতে হবে, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কারণ আমার মা মনেপ্রাণে চাইতেন তার ছেলেমেয়েরা ভালো কিছু করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। যেহেতু আমার মায়ের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সে কিছু করতে পারেনি। এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেছি বি এফ শাহীন কলেজ থেকে। তারপর অনার্স-মাস্টার্স করেছি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রামের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি। আসলে এক রকম ভালো লাগা থেকেই এই কাজগুলো করা। সবকিছু করার পাশাপাশি সবসময় একটা জিনিসই মাথাতে থাকতো,  যে আমাকে উপার্জন করতে হবে। আর সেই চিন্তাধারা থেকেই আমার প্রথম অনার্স প্রথম বর্ষে একটা কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেই। বাসায়ও কিছু ছেলেমেয়েকে পড়ানো শুরু করি। আমার প্রথম উপার্জনের উৎস ছিল এটাই। 

পরে আরও তিনটা কোম্পানিতে চাকরি করার সুযোগ হয় আমার, কখনোই থেমে থাকিনি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু না কিছু করেই গেছি। আর্নিং আর যেহেতু আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মেয়ে, অবশ্যই আমার পরিবার অনেক বেশি সচ্ছল ছিল না। সবসময়ই একটা-না-একটা চাহিদার কমতি ছিল, যদিও আমার বাবা সেটা পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। তারপরও আমার ছোট দুই ভাইবোন আছে, ওদের কথা চিন্তা করে আমার সবসময়ই মনে হয়েছে যে, আমাকে কিছু করতেই হবে। 

আমার বন্ধুবান্ধব যারা ছিল, ওরা সবসময় একটা কথাই বলত যে, তুই  পড়ালেখা কর। চাকরি পরে অনেক করতে পারবি। কিন্তু আমার চিন্তাধারা ছিল অন্যরকম। আমার বাবা একা পুরো পরিবার চালান, তার হেল্পিং হ্যান্ড কেউ ছিল না। আমি অল্পস্বল্প যাই করি, তাইতো আমার পরিবারে কাজে লাগবে। হ্যাঁ, আমি একজন মেয়ে কিন্তু আমি কি পারি না আমার বাবার ছেলে হিসেবে কিছু করতে। আমি নারী, আমিও পারি। আমি কখনোই বাধাগ্রস্ত হলেও পিছ পা হইনি। 

২০১৫ সালে আমার বিয়ে হয়। ২০১৭ তে আমি আমার মাস্টার্স সম্পন্ন করি। তারপর কিছু দিন ঘরে বসে থাকা। তখনই কুকাপ নামে একটা প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকের মাধ্যমে আমি দেখি। এবং আমার মাকে বলি, চলো আমরা রান্না নিয়ে কিছু করি, যেহেতু আমার মা খুব ভালো একজন রাঁধুনী, যেটা না বললেই নয়। তারপর কুকাপের সঙ্গে ওদের শেফ হয়ে কাজ করা। আমি জানি, আমি চাইলে ভালো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অথবা ব্যাংকে জব করতে পারতাম। কিন্তু কেন যেন এই রান্না করাটা আমার অনেক ভালো লাগাতো এবং টুকটাক কাজ করতে লাগলাম। 

২০১৮ সালে আমার বাচ্চা হয়। বাচ্চা হওয়াতে ওকে আমার অনেক সময় দিতে হতো। আমার নিজের জন্য কোনো সময়ই আমি বের করতে পারতাম না। খুব হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম বাসায় থাকতে থাকতে। এই সময়গুলোতে কুকাপের সঙ্গে আমার তেমন কাজ করা হচ্ছিল না। আসলে আমি সময় করে উঠতে পারছিলাম না। একদিকে সংসার আরেক দিকে ছোট বাচ্চা।  ফেসবুকের বদৌলতে শপআপের সঙ্গে আমার কমিউনিকেশন শুরু হলো। ওরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল। অফার করল ওদের উদ্যোক্তা হিসেবে জয়েন করার জন্য। এদিকে ওদের সঙ্গে কাজ করা শুরু। আমার নিজের একটা পেজ খোলা হলো, যার নাম ‘কাফিআস কালেকশন’। ওদের প্রস্তাবে আমি অরিজিনাল পাকিস্তানি ড্রেস নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমি অনেক ভালো ফিডব্যাক পেয়েছি। কাস্টমাররা আমার কালেকশনের অনেক ভালো রিভিউ দিত। পাশাপাশি কুকাপের সঙ্গে কাজ করছিলাম।  ভালোই রেসপন্স পাচ্ছিলাম কুকাপ থেকে আমার ফুডের। আমি সবসময়ই চেয়েছি, আমার নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে। 

২০২০ সালে আমার ছোট ভাই আমাকে বললো যে, তুমি একটা ফুডের পেজ খোলো। তোমার খাবারগুলো অনেক ক্রিয়েটিভ, ভালো সাড়া পেতে পারো। ওর আগ্রহে আমার ডেজার্ট স্টোরিজ ওপেন করা। আমি নিজেও একজন ডেজার্ট লাভার এবং তৈরি করতেও ভালোবাসি। এই ভালোবাসাটাই এক সময় নেশা এবং পেশায় পরিণত হয়ে গেলো।  ফুড নিয়ে আমার কাজ করা শুরু পুরোদমে। আমি চেয়েছি প্রফেশনাল শেফ  হতে, নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে। 

ডেজার্ট স্টোরিজের সিগনেচার ডেজার্ট বিস্কুটি ডিলাইট। ২০২০ সালের শেষের দিকে টনি খান কালিনারি ইনস্টিটিউট থেকে প্রফেশনাল পেস্ট্রি   অ্যান্ড বেকারির একটা কোর্স কমপ্লিট করি। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীনে ডিপ্লোমা ইন কালিনারি আর্টস অ্যান্ড ক্যাটারিং ম্যানেজমেন্টে এডমিশন নিয়ে এখন পড়াশোনা করছি। আমার কাছে মনে হয়, জানার এবং শেখার কোনো বয়স সীমা এবং সময়সীমা নেই। আমি নিজে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি, সেই প্ল্যাটফর্মে নতুন যারা উদ্যোক্তা হতে চান, পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই অংশগ্রহণ করতে পারবেন। যারা ফুড নিয়ে কাজ করতে চান। কিন্তু  আর্থিক সামর্থ্য এবং পরিবারের সাপোর্ট না থাকার কারণে পারছেন না, তাদের নিয়ে আমার এবং আমার পার্টনার কনা আহমেদের কিছু করার চেষ্টা। এবং সেই চেষ্টা থেকেই ‘কাফিয়া অ্যান্ড কনার্স কালিনারি স্টুডিও খোলা। 

বর্তমানে এটা নিয়ে ভালোভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছি। আশা করছি আপনারা সবাই আমাদের অনেক সহযোগিতা করবেন, যারা এই সেক্টরে আসতে চাচ্ছেন। আমাদের এই কালিনারি স্টুডিওতে আরও নতুন অনেক প্রশিক্ষক জয়েন করবেন। যাদের কাছ থেকে আশা করছি আপনারা অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আমরা কথায় না আমরা কাজে বিশ্বাসী হবেন। এই চিন্তাধারা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। 

প্রতিনিয়তই আমি সমাজব্যবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক সবকিছু নিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু আমি থেমে নেই। আমার কাজগুলোকে ভালোবেসে ধৈর্যের সঙ্গে করে যাচ্ছি। এগিয়ে যেতে চাই। সঙ্গে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। অনেক দূর যেতে চাই। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। 

আমার ছোট ভাই ‘নাজীব’, যাকে আমি মোটামুটি সবসময়ই আমার কাজে সাহায্যের জন্য পেয়েছি। কিছু হলেই ওকে আগে জানাই এবং ওর কাছে পরামর্শ চাই। আশাকরি সে আমাকে বাকি সময়েও সহযোগিতা করবে। 

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ডেজার্ট স্টোরিজ, কাফিয়াস কালেকশন এবং সিইও কাফিয়া অ্যান্ড কনাস কালিনারি স্টুডিও।

ঢাকা/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়