ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

কালীগঞ্জের কাঁকরোল যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে

রফিক সরকার, গাজীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৮, ৭ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৬:৩৮, ৭ আগস্ট ২০২১
কালীগঞ্জের কাঁকরোল যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে

গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বালু নদীর কূল ঘেঁষে বির্তুল গ্রাম। এটি বিষমুক্ত সবজির জন্য খুবই পরিচিত। সব মৌসুমে সব ধরনের সবজির চাষ হয় এখানে। তবে এই গ্রামের সবজি চাষিরা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাজার দখল করে রেখেছে বির্তুল গ্রামের কাঁকরোল। এতে একদিকে যেমন ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন কৃষক, অন্যদিকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বির্তুল গ্রামের কাঁকরোলের সুনাল ছড়িয়ে পড়ছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রাও আয় হচ্ছে।

বর্তমানে ওই গ্রামে সবচেয়ে বেশি ফলন হচ্ছে কাঁকরোল। যে কারণে এই গ্রামকে এখন মানুষ কাঁকরোলের গ্রাম বলেই জানেন। একেবারে বালু নদীর কূল ঘেষে আবাদি জমি হওয়ায় পর্যাপ্ত সেচ এবং উর্বর মাটির কারণে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে প্রতিবছর। পুরো গ্রামটি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নানা মৌসুমি সবজির উপর নির্ভরশীল। তাই স্থানীয় কৃষকরা কাঁকরোল চাষে বেশি আগ্রহী। 

কাকরল চাষের জন্য ৫ ফুট উঁচু বাঁশের খুঁটির সাথে সুতার বুননে তৈরি হয় মাচা। মাটিতে কাঁকরোলের মূল লাগিয়ে দিলে লতানো ডগা মাচায় গিয়ে বিস্তার লাভ করে। আর এর ফাঁকে ফাঁকে ছিটানো জৈব সারে কাঁকরোল গাছ পরিপক্ক হয়ে ফল দিতে শুরু করে। তবে মাস খানেকের মধ্যেই একটি কাঁকরোল গাছ ফল দিতে শুরু করে। 

কথা হয় বির্তুল গ্রামের কৃষক ষাটোর্ধ্ব আব্দুল লতিফ মোল্লার সাথে। তিনি প্রতিবছর ১ বিঘা জমিতে কাঁকরোলের আবাদ করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন বলে জানান।

তিনি আরও জানান, তার একটি মাছের খামার রয়েছে। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তিনি ১ বিঘা জমিতে কাঁকরোলের চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় ২০ কেজি কাঁকরোলের মূল লাগলেও তিনি তা স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করেন। সব খরচ একসাথে করলে বিঘা প্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। ফলন ঠিকঠাক থাকলে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন কাকরল উঠানো যায়। 

তিন দিনে প্রায় ২০০ কেজি কাঁকরোল উঠানো যায়। পরে পাইকাররা এসে তা নিয়ে যান। তারা প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে বির্তুলের কাঁকরোল বিদেশ পাঠান। এখন লকডাউনে যথাযথ মূল্য না পেলেও অন্যান্য সময় বেশ মূল্য পাওয়া যায়। গত বছরও লকডাউনের কারণে মূল্য প্রাপ্তি কিছুটা ঘাটতি ছিল। তবে সামনে লকডাউন কমলে সঠিক মূল্য পাওয়ার আশা করেন কৃষক আব্দুল লতিফ। 

একই গ্রামের তরুণ আরেক কৃষক নীল কমল চন্দ্র দাস (৩২) জানান, তিনি সিংঙ্গাপুর প্রবাসী ছিলেন। তিন বছর প্রবাস জীবন অতিবাহিত করার পর গত বছর দেশে আসার পর করোনা পরিস্থিতির কারণে আর সিঙ্গাপুর যেতে পারেননি। কিন্তু পরিশ্রমী নীল কমল বসে থাকার পাত্র না। তাই তিনি এবার কৃষি কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। এবছর প্রায় ১ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন কাঁকরোল। খরচ করেছেন ২৫ হাজার টাকা। প্রতি কেজি ২৮/৩০ টাকা দরে বিক্রি করে ইতোমধ্যে তিনি তাঁর টাকা উঠিয়ে ফেলেছেন। যদি অতিরিক্ত বর্ষা না হয়, তাহলে তিনি ১ থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

কৃষক নীল কমল চন্দ্র দাস আরও জানান, তার গাছের কাকরল রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। তিনি কাঁকরোলকে দুইটি গ্রেডে ভাগ করেন। গ্রেড-এ এবং গ্রেড-বি। গ্রেড-এ এর কাকরল রপ্তানিকারকরা বাড়িতে এসে নিয়ে যান। আর গ্রেড-বি এর কাকরল স্থানীয় পাইকাররা কিনে নেন। নীল কমলের ইচ্ছা আগামীতে আরও বেশি জায়গায় তিনি কাঁকরোলের চাষ করবেন।

রপ্তানিকারক মো. শরীফ সরকার জানান, তিনি প্রায় আট বছর যাবৎ এই ব্যবসার সাথে জড়িত। আগে তিনি এই বর্তুল গ্রাম থেকে বরবটি ও লাউ রপ্তানি করতেন। কিন্তু বর্তমানে কাঁকরোলের চাহিদা এবং দাম ভালো পাওয়ায় তিনি শুধু কাকরলই রপ্তানি করছেন। তিনি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে ভালো মানের কাঁকরোল সংগ্রহ করে তা বিমানবন্দর কাস্টমসের কাছে নিয়ে যান। পরে তারা যাচাই-বাছাই এবং পরীক্ষা করে তার মূল্য দেয়। মৌসুমে তিনি প্রতি মাসে প্রায় ২৪০ টন করে কাঁকরোল রপ্তানি করছেন বলেও জানান। তবে মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে দুবাই, কাতার ও সৌদি আরবে কাঁকরোলের চাহিদা অনেক বেশি। তিনি আশা করছেন আরও চার মাস এই কাকরল রপ্তানি করতে পারবেন।

নাগরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. অলিউল ইসলাম অলি বলেন, বির্তুল গ্রামের কৃষকদের নাগরী ইউনিয়ন কৃষি বিভাগ থেকে নানা কৃষি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি উপজেলা  কৃষি অধিদপ্তর তো তদারকি করছেই। এতে স্থানীয় কৃষকরা আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছে। পাশাপাশি বির্তুল গ্রামের বিষমুক্ত সবজি স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছে। তবে বিশেষ করে ওই গ্রামের কাঁকরোল মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, কাতার ও সৌদি আরবের বাজার দখল করে রেখেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।      

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে প্রায় ৪০ হেক্টর জমিতে কাঁকরোলের চাষ হচ্ছে। যা গত বছরের তুলনায় ২ হেক্টর বেশি। প্রাথমিকভাবে আমরা কৃষকদের বিভিন্ন রকম ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকি। যেমন প্রচুর পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করা, পোকামাকড় দমনে বিভিন্নরকম ফাঁদ ব্যবহার এবং ফলন বৃদ্ধিতে পরাগায়ন। আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি, আমাদের এবারের ফলন গত বছরের তুলনায় বেশি, যা সন্তোষজনক। সবচেয়ে বড় ব্যাপার উপজেলার এই বির্তুল গ্রামের কাঁকরোল এখন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশ পাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আর স্বাবলম্বী হচ্ছে স্থানীয় কৃষক।

/মাহি/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়